রাজধানী থেকে শুরু করে বিভাগীয় ও জেলা শহর সকল এলাকায়ই রাস্তায় ও রাস্তার মোড়ে লোকজনের ভালো সমাগম ঘটছে। গ্রামাঞ্চলেতো লোকজনের চলাচল স্বাভাবিক।
অপরদিকে চীন ছাড়া পুরো বিশ্বের করোনা পরিস্থিতি দিন দিন করুণ থেকে করুণতর হচ্ছে। সারাবিশ্বে মোট মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৮৩ হাজারেরও বেশি। আর আক্রান্ত ১৪ লাখের বেশি। ইউরোপের দু দেশ ইতালি ও স্পেনের অবস্থা একেবারেই নাজুক। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকে কেউ বলতে পারছেন না।
একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখলাম, মোট আক্রান্তের ৮১ শতাংশই ১০টি উন্নত দেশের। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ৬টি দেশ ইউরোপের (ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড) এবং ৩টি এশিয়ার (চীন, ইরান ও তুরস্ক)।
তবে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, যে দেশগুলো স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা খাত ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত সে দেশগুলোতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করছে। পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রতি একশ বছরে এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতার কালে এভাবে একটি বিপর্যয় নেমে আসবে তার ভবিষৎ বাণী কেউ কখনও করেইনি; বরং এটা কল্পনাতীত। একটি ভাইরাস আজ মানবসভ্যতাকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিয়েছে। দু’ দুটি বিশ্বযুদ্ধও মানবসভ্যাতাকে এতো সংকটে ফেলেনি। সবার ভয় ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু তার আর দরকার পড়েনি। করোনাই তার করুণ উত্তর আমাদের দিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যিনি সবসময় একটা ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চলতেন তিনিও পরিস্থিতি সামাল দিতে কূলকিনারা পাচ্ছেন না।
যুক্তরাজ্য, যাদের চিকিৎসা ও ওষুধসামগ্রীর ক্ষেত্রে অনেক পেটেন্ট রয়েছে, তারা বলছে মৃত্যু বিশ হাজার না ছাড়ালে তারা সফল। তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে সে দেশের রাজতন্ত্রের দ্বিতীয় উত্তরাধিকার অর্থাৎ বর্তমান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পর যার হাতে ব্রিটেনের শাসনভার যাবে সেই প্রিন্স চার্লস, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তথা বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী বরিস জনসন ও তার কেবিনেটের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা হেলথ সেক্রেটারি ম্যাট হেনকক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। যে দু ব্যক্তি করোনার বিরুদ্ধে মূল যোদ্ধা ছিলেন, তাদের দুজনই আজ কোয়ারেন্টিনে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন করোনা ঝুঁকিতে। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত। তিনি পুতিনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। কারন তার সংসদীয় উপদেষ্টা ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন। মুসলমানদের পবিত্র দু স্থান মক্কা ও মদিনায় পর্যন্ত জমায়েত সীমিত করা হয়েছে। আসন্ন মৌসুমে হজ্জ হবে কি না সৌদি সরকার এখনও তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরার আপডেট থেকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের অবশ্যই আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমরা যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের সতর্কতা শুনি, তখন আতংকিত না হয়ে থাকতে পারি না। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের করোনা পরিস্থিতি নাজুক হওয়া সত্বেও তাদের নাগরিকদের যখন সে দেশে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমাদের আতংকের মাত্রা বেড়ে যায়। কয়েকদিন আগেও জাপানের দূতাবাসের কর্মকর্তা ও মেট্রোরেল এবং মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিশেষজ্ঞরা চার্টাড ফ্লাইটে ঢাকা ছেড়েছেন। এসব ঘটনা আমাদের শংকিত করে তোলে।
যাই হোক, আমরা করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় মনে হয় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি লকডাউনের জন্য দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষদের কীভাবে খাদ্য সরবরাহ করবো সেটার ওপর। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণেও যাতে মানুষ না খেয়ে মারা না যায়, সেটা বার বার উঠে এসেছে।
কিন্তু যে জিনিসটির ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ তা হলো করোনায় আক্রান্তদের শনাক্তকরণ। দেশে এতদিন টেস্ট কিট ও শনাক্তকরণ যন্ত্রের ঘাটতি ছিল। বর্তমানে সে সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও আমরা শনাক্তকরণ কার্যক্রম জোরদার করতে পারছি না। এখনও আমরা যতটা জীবিত মানুষ আক্রান্ত কি না সেটা শনাক্ত করণের পাশাপাশি যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গিয়েছেন তাদের নমুনা সংগ্রহ করে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার বিভাগীয় শহরগুলোর পাশাপাশি জেলা শহরগুলোতে অন্ততঃ শনাক্তকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। যদিও জনবহুল ছোট্ট দেশটির প্রতিটি উপজেলায় করোনা শনাক্তকরণের ব্যবস্থা এরইমধ্যে গড়ে ওঠার কথা। করোনা বিশ্বে মহামারি আকার ধারন করতে আমরা ৩ মাসের বেশি প্রস্তুতির জন্য পেয়েছি। আর সেই প্রস্তুতিটা অবশ্যই হওয়া উচিৎ ছিল করোনা শনাক্তকরণ ও আক্রান্তদের চিকিৎসার প্রস্তুতি।
বাংলাদেশে বর্তমান ঋতুতে এমনিতেই অনেকে সর্দি, কাশি, জ্বর, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা ও মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হন। এগুলো কিন্তু করোনা আক্রান্তেরও লক্ষণ। যদি সত্যি সত্যি এদের মধ্যে কেউ করোনায় আক্তান্ত হয়ে থাকেন তাহলে আমাদের পরিস্থিতি কতটা খারাপ পরিণতির দিকে যাচ্ছে তা ভাবনার বিষয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ৭/৮ দিন লেগে যায় করোনার উপসর্গ প্রকাশ হতে। তাহলে দেখুন আমরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছি। দেখা যাবে, আমরা একজন করোনা আক্রান্তের সাথে অবলীলায় মেলামেশা করছি। অথচ তার টেস্ট করলে দেখা যাবে তিনি করোনায় আক্রান্ত। আবার যার করোনার সকল উপসর্গ আছে তাকে টেস্ট করলে দেখা যাবে তিনি প্রকৃতপক্ষে করোনায় আক্রান্ত নন। শুধু শুধু তিনি সোস্যাল স্টিগমার শিকার হচ্ছেন।
তাই করোনা আক্রান্ত অথচ তিনি অবাধে চলাচল করছেন তার মাধ্যমে পরিস্থিতি কতোটা খারাপের দিকে যেতে পারে একবার কি আমরা তা ভেবে দেখছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, প্রিন্স চার্লস, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হেনকক কারোরই কিন্তু করোনা আক্রান্তের কোনো উপসর্গ দেখা যায়নি। তারা নিয়মিত চেক আপের অংশ হিসেবে করোনা টেস্ট করান। আর ফলাফল হলো তারা সকলেই করোনা আক্রান্ত। যদি সময় মতো এ টেস্টটি তারা না করতেন তাহলে কী পরিমান ভিভিআইপিরা করোনা আক্রান্তের শিকার হতেন একবার ভাবা যায়। অপরদিকে, জার্মানির চ্যন্সেলর আঙ্গেলা মেরকেলের করোনার অনেকগুলো উপসর্গ থাকায় তিনি একঘরে হয়ে নমুনা শনাক্তকরনের জন্য দিয়েছিলেন। পরে তার করোনা নেগেটিভ এলো। তিনি আবার পুরো উদ্যোমে কাজ শুরু করলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন টেস্ট, টেস্ট আর টেস্ট। সুতরাং এ মুহূর্তে বাংলাদেশের উচিত করোনা শনাক্ত ব্যবস্থা জোরদার করা। ১৬ কোটি মানুষের দেশে অন্তত ১ লাখ নমুনা যদি আমরা পরীক্ষা করি, তাহলে পরিস্থিতির একটা চিত্রেউঠে আসবে।
লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট