আইইডিসিআর জানিয়েছে, সামাজিকভাবে সংক্রমিত হতে শুরু করেছে কভিড-১৯। বিশ্ব নেতারা যখন কভিড-১৯ এর উৎস সন্ধানে জড়িয়ে পড়েছেন নতুন রাজনীতিতে, মাস্ক ছিনতাই করছে যুক্তরাষ্ট্র, তখন বাংলাদেশে সকল নির্দেশনা-গণবিজ্ঞপ্তি উপেক্ষা করে বলতে শোনা যায় ‘আল্লাহ ভরসা’।
করোনা মোকাবেলায় প্রথম ও প্রধান যে নির্দেশনা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যখন কেউ মানছি না, তখনই লাঠি হাতে তুলে নিতে হয় বাংলাদেশ পুলিশকে।
গরিবদের জন্য সরকারের বরাদ্দের চাল চুরিতে যখন জনপ্রতিনিধিরা মত্ত, ঠিক তখন রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে অজপাড়া গাঁয়ের প্রায় ১৭ কোটি মানুষকে সামাজিক দূরত্ব শিখাতে ব্যস্ত এই পুলিশ। ক্রান্তিকালে বিপদগ্রস্থ মানুষের শিক্ষক, ঘরের বাজার করার ছেলে, ওষুধ কিনে দেওয়ার লোক, লাশ দাফনের মোতয়াল্লি, ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার পরও কি মনে হয় পুলিশ শুধু পুলিশ আছে? এখনো কি পুলিশ দেখলে আপনার গালি আসে?
তাহলে আরেকটু খোলাসা করে বলতেই হয়। রাষ্ট্রের প্রয়োগিত স্তম্ভ হচ্ছে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব বাহিনীর মধ্যে নৌ, স্থল ও আকাশ পথ প্রতিরক্ষায় আলাদা আলাদা ইউনিট রয়েছে। আর কোটি কোটি মানুষের হ-য-ব-র-ল সিস্টেমটাকে আয়ত্বে রেখে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অভিপ্সা আইন বাস্তবায়নে কাজ করে পুলিশ। ফলে পুলিশ সর্বত্র-সামগ্রিক শৃঙ্খল। কোটি মানুষের সাথে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করায় ভুল-ত্রুটিও ব্যক্তিবিশেষে ধরা পড়ে। আর তা নিয়ে বাতচিৎও কম হয় না। যেহেতু বিয়ে, খৎনা, চেহলাম, অন্নপ্রাসন, মিলাদ, ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি কমাতে, প্রটোকল মেইনটেইনের মত সকল কাজে, সকল ভাঁজে পুলিশকে পাওয়া যায়; তাই আমাদের চোখে পুলিশের ‘মূল্যও’ একটু কম। অন্য বাহিনী দেখলে যেভাবে চোখ বড় হয়ে ওঠে, সতর্ক হই; সামগ্রিক পুলিশ দেখলে আমরা ভাবলেশ; গত্যান্তরহীন। তাইতো পান থেকে চুন খসলে পুলিশকে গালি দিতে কেউ পিছপা হই না। কিন্তু পুলিশ কাজ করে কার জন্য? এই চিন্তাটা কি কখনো আপনার মাথায় এসেছে? না হলে আর ভাবতে হবে না।
৮ মার্চ যখন বাংলাদেশ করোনাক্রান্ত হলো, সেদিন থেকে মানুষের মধ্যে চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করে। কি জানি কী হয়? সরকার ঘোষণা দিলো সকল মানুষকে ঘরে ফেরার জন্য। সমাগম ত্যাগ করে ঘরে থাকতে শুরু হলো কাউন্সেলিং। মানুষ কিন্তু তখনও তামাশা ভেবে নির্দেশনাগুলো উড়িয়ে দিচ্ছিল।
একটি রাষ্ট্রের হাতেগোনা যে কয়টি নিয়ামক বিপদগ্রস্ত অবস্থায় সবোর্চ্চ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে থাকে সেই স্তম্ভগুলো কিন্তু সেই দুর্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ডাক্তার, পুলিশ এবং সাংবাদিক। ডাক্তার এবং পুলিশ রাষ্ট্রের প্রথম স্তম্ভের অংশ। তার সাথে জুড়ে বসে তৃতীয় চোখ গণমাধ্যম। করোনা যুদ্ধেও কিন্তু দ্বিতীয় চোখ অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের পিছপায়ের নিদর্শন পূর্বের মহাক্রান্তির মতই। ফলে সমন্বয় করতে হচ্ছে উপকারইচ্ছুদের নিয়েই। তবে তর্ক আছে আমাদের ডাক্তারদের মনোবাসনা নিয়েও। কভিড-১৯ দেশে আমদানি হওয়ার পর মানব শরীর ঘেঁটে মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা ডিপোজিটকারীদের কেউ কেউ আনাগ্রহ দেখালেন চিকিৎসা দিতে। কেউ কেউ দিলেন চাকরি ছাড়ার আবেদন। কর্মবিরতি পালন, অতঃপর ব্যক্তিগত বা বেসরকারি চেম্বার থেকে উধাও ডাক্তার। সরকারি হাসপাতাল থেকেও হয়তো ক্রমে ক্রমে ‘নাই’ হয়ে বাসায় ঘাপটি মেরে থাকতেন যদি প্রধানমন্ত্রী তল্পিতল্পা গোটাতে না বলতেন। শেষতক দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো উঠে দাঁড়িয়েছে করোনা প্রতিরোধে। ভারত যে ডাক্তারকে করোনা যুদ্ধে ‘সাক্ষাৎ ইশ্বর’ বলে অভিহিত করছে; বাংলাদেশে তা কি আমরা পারছি? সংশয় থেকে যায়।
কিন্তু এই করোনা মোকাবেলার ঘোষণা দেওয়ার পর টানা একমাস অতিক্রম করলো দেশ। এরমধ্যে কতজন পুলিশ চাকরি ছাড়ার আবেদন করেছেন? তাদের কি মৃত্যুর ভয় নেই? তাদের ঘরে কি সন্তান-সন্তদি নেই? পুলিশ কি মাটিতে তৈরি যে তাকে করোনা আক্রমণ করবে না? এসবই মিথ্যে। করোনা রোগীর সংস্পর্শে এলে পুলিশ আক্রান্ত হবে। ছেড়ে দেবে না। তারও হৃদয় কাঁদে মা, স্ত্রী, সন্তান, স্বজনদের জন্য। পুলিশও নিরাপত্তাহীনতায় শতভাগ। তারপরও সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে-আমাকে, আমাদের পরিবারকে বাঁচাতে তারা করোনার সাম্রাজ্যে নেমেই কাজ করছে। এটাকে চাকরি বলে না; বলে দেশপ্রেম।
পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়ে পায়নি এমন দৃষ্টান্ত নেহাৎ নেই বললেই চলে। বাপ মারা যাওয়ার পর ছেলে পালিয়ে গেলেও সেই লাশ কাঁধে নিয়ে ধর্মীয় রীতি মেনে শেষ বিদায় জানাচ্ছে পুলিশ।
ঘরবন্দী মানুষ যখন টিভিতে একই ঘটনার সংবাদ, একই সিরিয়াল, একই আলোচনা শুনে হাঁপিয়ে উঠছে, পুলিশ তখন সাউন্ড বক্স, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় গান করে, হাস্যরস জুগিয়ে মানুষের ক্লান্তি ঘোচাচ্ছে। আর চব্বিশ ঘণ্টা সড়কে, মানুষের বাড়ি; আনাচে-কানাচে নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে মানুষ সতর্ক করে বেড়াচ্ছে। এত কিছু কেন তাকে করতে হবে? যে বেতন পান তাতে কি এসব করতে বাধ্য পুলিশ? মোটেই না। বরং পুলিশের চেয়ে বহুগুন বেশি বেতনের অনেকেই রয়েছেন যারা এসব পছন্দ করেন না। বস্তুত স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখার পর পুলিশ হয়ে উঠেছে আপদমস্তক মানবিক বাঙালি সত্ত্বা। পুলিশ তার কাছে একটি পেশা; ঘরে মা-বোন-স্ত্রী-সন্তানের মুখে খাবার দেওয়ার মাধ্যম। কিন্তু নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশ ও বাঙালির কল্যাণার্থে। তাইতো পুলিশ করোনা যুদ্ধে সর্বাগ্রে সাইরেন বাজিয়ে এগিয়ে চলছে। দেশকে সুরক্ষা দিচ্ছে। এরপরও কি পুলিশ দেখলে আপনার গালি আসে? বরং দৃশ্য তার উল্টো। করোনা থেকে বাঁচতে সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা হচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশ। ভারতে ডাক্তার যদি ‘সাক্ষাৎ ইশ্বর’ হন বাংলাদেশে সমরনায়ক নিঃসন্দেহে পুলিশ। করোনা যুদ্ধে বাহিনীর নামের বৈশিষ্ট্য সবগুলোই পুঙ্খানুপুঙ্খ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সমালোচনা নয়, আসুন তাদের উৎসাহিত করি। অনুপ্রেরণা দেই। ১৭ কোটি হাত বাড়িয়ে দেই রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য। অন্তত কিছুদিন মেনে চলি নির্দেশনা। দেখবেন আপনি বেঁচে যাবেন, দেশটা বেঁচে যাবে। ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
পুনশ্চঃ করোনায় রাষ্ট্রের তৃতীয় চোখ সাংবাদিকদের অবদানের সর্ম্পকে নতুন করে বলার কিছু নেই। পুলিশের মতই নিরাপত্তাহীনতায় কাজ করে চলেছেন তারা। পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার খবর না পাওয়া গেলেও ইতিমধ্যে সংবাদকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং সাংবাদিকদের নিয়ে সাংবাদিকের ‘শির উন্নতকরণ’র কিছু নেই। করোনা যুদ্ধে যে চোখ ছাড়া রাষ্ট্র অন্ধত্ব বরণ করতে পারে তা হলো গণমাধ্যম।
লেখক: কবি ও সংবাদকর্মী