যুদ্ধ শেষ হলো, বিজয়ের পতাকা নিয়ে ব্রিটিশ জাতি স্যালুট জানিয়েছিলো এই ‘ল্যান্ড গার্লদের’, তাদের অতিমানবীয় অবদানের জন্য ভূষিত করা হয়েছিল ‘ল্যান্ড হিরো’ সম্মানে।
সর্বব্যাপী এক মহাযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উইনস্টোন চার্চিলের মতো আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে প্রতি ইঞ্চি মাটি কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত ফসল ফলানোর প্রত্যয়ে মাঠে নামতে মিনতিপূর্ণ অনুরোধ করেছেন।
করোনার এই বৈশ্বিক সংকট কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না। আজকে খাদ্য গুদামে চাল আছে, তাই ত্রাণ বিতরণ আছে, ত্রাণের চাল চুরি আছে, ফটোসেশন আছে। চোখ বন্ধ করে ভাবুনতো একবার- ভাতের সংস্থান না করতে পারলে ১৮ কোটি ভেতো বাঙালির কী হবে? করোনা যুদ্ধের পাশাপাশি যে আশংকা আতংকিত করছে সেটা হচ্ছে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ। ভেঙে পড়া সাপ্লাই চেইন, বিপন্ন উৎপাদন ব্যবস্থা, স্থবির আমদানি-রপ্তানি ও বিপণন আগামীর খাদ্য নিরাপত্তাকে চরম সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক স্পর্শকাতর ও জটিল। যদি করোনা সংকটে আমাদের ১০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদনও কমে যায়, যদি প্রন্তিক ও ভূমিহীন কৃষক (মোট কৃষকের ৮৪%) সইতে না পারে অব্যাহত লোকসানের অভিঘাত। টাকা দিয়ে খাদ্য আনতে পারবেন কোথাও থেকে? অসহায় পুঁজিবাদ আপনাকে পকেট ভরে টাকা দিতে পারলেও একমুঠো খাবার দিতে পারবে না। করোনায় মৃত্যুর মিছিল হয়তো থামবে, আবার চালু হবে সভ্যতার চাকা, কিন্তু খাদ্য কোথা থেকে পাবেন?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মিনতি দেশবাসীকে কতটুকু স্পর্শ করেছে জানি না, তবে আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবাইকে ব্রিটেনের উইমেনস ল্যান্ড আর্মির মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। করোনাকালে সময় এসেছে কাস্তে-মাতুল নিয়ে কৃষকের সঙ্গে মাঠে নামার। বাংলাদেশের ৮৪ শতাংশ ভূমিহীন, প্রন্তিক ও ক্ষুদ্র চাষীর ঘাম-শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের কৃষি অর্থনীতি, সমৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা। এই অন্ন কারিগর প্রান্তিক চাষীর বিপন্নতা কী আপনাকে স্পর্শ করছে? প্রিয় সুশীল, আপনি করোনার ভয়ে নিরাপদে ঘরে থাকলেও সংসপ্তক কৃষক আছেন ফসলের মাঠে। সম্প্রসারণ কর্মী আছেন কৃষকের সঙ্গে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক ‘ট্রেড ওয়ার’ ও বহুজাতিক আধিপত্যবাদের দমকা বাতাস, মুক্তবাজারের পীড়ন, পুঁজিবাদের চাপেটাঘাত ,‘মার্কেটিং নৈরাজ্য’ এবং বিশ্বায়নের তুমুল ঝাঁকুনি সবই সয়ে যায় কৃষকের শীর্ণ দেহে। কৃষক লড়াই করে যায় তার সবটুকু দিয়ে। শ্রমনিবিড় কৃষিকে বাঁচাতে ‘ল্যান্ড আর্মি’র মতো স্বেচ্ছাশ্রমের লক্ষ হাত আজ খুব দরকার। ব্রিটেনের ‘উইমেন ল্যান্ড আর্মি’র মতো ছাত্র-যুবাদের নিয়ে আমরাও গঠন করতে পারি ‘বাংলাদেশ ল্যান্ড আর্মি’।
সভ্যতা আজ বিপন্ন। সর্বব্যাপী এক যুদ্ধ শুরু হয়েছে দশ দিগন্তে; বলকান থেকে ককেশাশ, খয়বার থেকে মন্ট্রিল, আমাজান থেকে নাইরোবি। করোনা সংকট দীর্ঘায়িত হলে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। প্রিয় সুশীল, আপনি কী উপলব্ধি করতে পেরেছেন, আগামীতে সবচেয়ে বড় লড়াইটা কার সঙ্গে? হ্যাঁ, পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় যুদ্ধ অপেক্ষা করছে ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের সঙ্গে। প্রিয় সুশীল, বাংলার কৃষক, কৃষিবিভাগ আর একজন শেখ হাসিনা একা পারবে না এই যুদ্ধ মোকাবেলা করতে। আপনি হয়তো ভাবছেন কৃষকের জন্য এত প্রণোদনা, ঋণ, সহায়তা, ভর্তুকী তাও কৃষক পারবে না খাবারের যোগান দিতে? না, পারবে না। সেদিন ব্রিটেনের ‘ল্যান্ড গার্লস’ যেভাবে ঘর ছেড়ে মাঠে নেমেছিলো, আজ আপনাকেও নামতে হবে। পিপিই পরে হাসপাতালে যুদ্ধ করছেন স্বাস্থ্যকর্মী। কাস্তে-মাথাল নিয়ে আপনাকেও মাঠে নামতে হবে প্রিয় সুশীল। ফটোসেশন অথবা লোক দেখানোর জন্য নয়। আপনাকে আবেগ ও ভালবাসা দিয়ে সত্যি সত্যিই মাঠে নামতে হবে, কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে, পাকা ধান কাটতে হবে, ঘরে আনতে হবে, মাড়াই করতে হবে। কৃষকের জন্য প্রণোদনা-ভর্তুকীর চেয়েও আপনার আবেগপূর্ণ পাশে দাঁড়ানো আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
মাননীয় প্রধামন্ত্রী প্রতি ইঞ্চি জায়গায় ফসল ফলাতে বলেছেন। হ্যাঁ, আপনি এক ইঞ্চি ফাঁকা জায়গা পেলেও একটা বীজ পুঁতে দিন। বৈশ্বিক ‘ফুড বাস্কেটে’ আপনার উৎপাদিত একটি দানা, একটি ডগাও আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, জাতীয় মুদ্রানীতি, বিশ্ব মন্দার জটিল হিসাবের চেয়ে ১৮ কোটি মানুষের ডাল-ভাতের চিন্তাই এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা। চালের আন্তর্জাতিক বাজার খুব সংকীর্ণ হওয়ায় ভেতো বাঙালির জন্য এই আশংকাটা আরও বেশি।
সরকারের আন্তরিকতা ও উদ্যোগের কোনো অভাব না থাকলেও ঋণ-ভর্তুকি-প্রণোদনা বিতরণের জটিল সিস্টেম ও অদৃশ্য হাত নিষ্ঠুরভাবে ঠকিয়ে দেয় কপালপোড়া ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীকে। ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার দক্ষ ‘ব্যাংকিং মেকানিজম’ আমাদের হাতে নেই। সরকারি খাদ্য গুদামে ধান-চাল ক্রয়ের মহাকাব্যিক উপাখ্যান কৃষকের তেমন কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। অদক্ষ বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি ’লক ডাউনের’ মতো অচলাবস্থায় কৃষক ও খামারী কেমন ক্ষতির মধ্যে পড়েছে কল্পনা করতে পারছেন? লোকসানের বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে এনে সুনির্দিষ্ট সহায়তা ও প্রণোদনা পরিকল্পনা করতে হবে।
আমাদের রাসায়নিক সার আসে রাশিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, চীন, মরক্কো, তিউনিশিয়া, সৌদি আরব থেকে। পেস্টিসাইড আসে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা থেকে। বীজ আসে চীন, জাপান, ভারত থেকে। সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়লে অবস্থা কী হতে পারে চিন্তা করেছেন। ট্রেড সম্পর্কিত নানা রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে কৃষি, তাই কৃষি ব্যবস্থাপনায় কোনো ক্রটি রাখা যাবে না। আর অবিচ্ছিন্ন ও দক্ষ কৃষি ব্যবস্থাপনার আপনার হাত দুটি আজ খুবই প্রয়োজন। মাঠে কৃষক ও সম্প্রসারণ কর্মীর সক্ষমতা গর্ব করার মতো। কিন্তু এ লড়াইয়ে আপনার অংশগ্রহণ ল্যান্ড হিরোদের সাহস যোগাবে। কৃষক ১৯৭১ এ যেমন লাঙলের ফলা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো গ্রেনেড, কামানের বিরুদ্ধে, আজ সময় এসেছে কৃষকের সেদিনের রক্তের ঋণ শোধ করবার। আপনি কী প্রস্তত?
কৃষকের লোকসানের কথা শোনার কেউ নেই। বাংলার সহজ সরল কৃষকের গার্মেন্টস মালিক বা পরিবহন শ্রমিকের মত কোন শক্তিশালী সংগঠন নেই, আওয়াজ তোলার মত চৌকস নেতা নেই, রাজপথ বন্ধ করে দেওয়ার মত একতা নেই, সরকারকে চাপে ফেলার কোন প্রেসার গ্রুপ নেই। ব্যাংক ঋণের কথা শুনলেই চমকে ওঠে আতংকিত ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষী। ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষককে বাঁচাতে ঋণ নয় সরাসরি আর্থিক সহায়তা দরকার। কৃষকের হাতে দ্রুত সহায়তা পৌঁছানোর ডিজিটাল সক্ষমতা আছে সরকারের। কৃষি বিভাগ এ কাজ তিন সপ্তাহতেই করতে পারবে। একই ব্যবস্থাপত্র দিয়ে সবাইকে বাঁচানো যাবে না। যে কন্টাক্ট চাষীর ফল, সবজি ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি হওয়ার কথা ছিলো তার কথা ভেবেছেন। রপ্তানিযোগ্য সবজির কন্টাক্ট ফার্মার, পরিবহন শ্রমিক, রপ্তানিকারককে বাঁচানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। চিংড়ি ও হিমায়িত মাছ বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি খাত। বাগদা চাষ মৌসুম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে ক্রেতা দেশগুলি। পুঁজি নিবিড় চিংড়ি শিল্প বাঁচাতে পৃথক প্যাকেজ নিতে হবে।
অস্ট্রেলিয়াতে খরা মোকাবেলায় সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি দেশের মানুষের কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি আমাদের জন্য অনুকরনীয়। এদেশের সুশীল সমাজ, রজানীতিবিদ, ছাত্র-শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী সবাই কৃষকের জন্য একটা দায়, কৃতজ্ঞতা, ঋণ অনুভব করে। খরা ও দাবানলে বিপন্ন কৃষককে বাঁচানোর জন্য অস্ট্রেলিয়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে, গান গেয়ে স্কুল ছাত্র, শিল্পি-খেলোয়াড়, রাজনৈতিক কর্মীকে সাহায্য চাইতে দেখেছি। কৃষককে পুশিয়ে দিতে এরা কৃষি পণ্যের ক্রয় মূল্যের সাথে ১০-২০ সেন্ট বেশি দেয় সানন্দে। তারা বোঝে আড়াই লাখ কৃষককে বাঁচিয়ে রাখার গুরুত্ব। আমাদের দেশে উল্টা চিত্র। বাংলাদেশে কৃষককে ঠকাতে পারলেই জিতে যায় সুশীল। কৃষক ঠকিয়ে উল্লসিত হওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আজ। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য কম দামে কিনতে পেরে জিতে যাওয়ার মানসিকতা পরিহার করতে হবে। মনে রাখবেন কৃষক ও কৃষি বাঁচলে আপনি বাঁচবেন।
আসন্ন খাদ্য সংকটের বিষয়টি মাথায় রেখে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে উৎপাদন কার্যক্রমে অবদান রাখতে হবে। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, পেশাজীবী, সবাইকে কিছু বীজ হাতে দিতে পারলে সে তার বাড়ির আঙ্গিনায়, রাস্তার পাশে, ছাদে, পুকুর পাড়ে লাগিয়ে দিয়ে যত্ন করতে পারবে। আমাদের উর্বর মাটি ও অনুকূল জলবায়ুতে বীজ বপন করলেই গাছ হবে, ফুল-ফল হবে। সেনানিবাস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যেসকল জায়গায় শাক-সবজির বীজ-চারা লাগানো সম্ভব সেখানে লাগাতে হবে। এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বীজ কোম্পানি বিনামূল্যে অথবা স্বল্প মূল্যে শাক-সবজির কিছু বীজ দিতে পারে সারাদেশে। কৃষকের ঘরে কিছু বীজ থাকে যেগুলো প্রতিবেশীর সাথে বিনিময় করা যেতে পারে। মিডিয়া এ বিষয়ে নিয়মিত পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করতে পারে। ভূস্বামী তার বর্গাচাষীর বর্গার টাকা এ বছর মওকুফ করে দিতে পারেন। সেচ পাম্পের বিদ্যুতের বিল মওকুপ করে দিতে পারে সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমেছে অনেক। সেচ কাজের জন্য স্বল্প মূল্যে ডিজেল দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ডাক্তারদের সঙ্গে যেমন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের যোগ দেওয়ার সময় এসেছে, তেমনি কমিউনিটি কৃষি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি ইনস্টিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এখনই।
যে কোনো সংকট মানুষকে সাহসী করে, প্রত্যয়ী করে, সৃজনশীল করে নতুন লড়াইয়ের জন্য। করোনা যুদ্ধ শেষ হবে একদিন, দিকে দিকে উদিত হবে নতুন স্বপ্ন। বিপর্যস্ত অর্থনীতি, বিপন্ন কৃষি, সমাজ-সভ্যতা আবার নতুন করে সাজানোর প্রত্যয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো নতুন অঙ্গীকার ও দেশপ্রেম নিয়ে। আপনার উৎপাদিত এক মুঠো অতিরিক্ত ফসলে বেঁচে যাবে একটি ক্ষুধার্ত জীবন, বিপন্ন মানবতা। কাল মহাকালের বুকে স্থান করে দেওয়ার সুযোগ নিয়ে হাজির হয়েছে আপনার সামনে। মহাকালের তারকা হওয়ার জন্য হাঁকিছে ভবিষ্যৎ। আসুন জাতির এই মহা সংকটে কৃষকের সঙ্গে সবাই মাঠে নামি, আমরাও হয়ে যাই ‘ল্যান্ড হিরো’।
লেখক: পিএইচডি ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া; সিভিল সার্ভেন্ট, বিসিএস (কৃষি)
[email protected]