শুধু আমি না, আমার মতো প্রথম প্রজন্মের গার্মেন্ট শিল্প একইভাবে বিকশিত হয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সকলের আত্মত্যাগেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশ।
২০১৪ সালে অবরোধের সময় ৪০ শতাংশের বেশি এয়ার শিপমেন্ট করে আমাদের বায়ারদের অনটাইম নিশ্চিত রেখেছি। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের শিল্পের মালিকরা কোনো প্রণোদনা পায়নি বা প্রণোদনা চায় না (নতুন বাজার তৈরির প্রণোদনা ছাড়া)। সবারই একই উদ্যেশ্য ছিল বাংলাদেশে ব্যবসা বাড়ানো। সবাই বড় বড় ফ্যাক্টরি করেছে। ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করে এক একটি কারখানায়। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর মেড ইন বাংলাদেশ যখন রক্তমাখা শার্ট ছিল সমস্ত বিশ্বের কাছে, যে ধ্বংস্তুপ থেকে কোনো প্রণোদনা ছাড়া তিন বিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করে বায়ারদের সন্তুষ্টির জন্য ফায়ার অ্যান্ড ইলেকট্রিক সেফটি বিল্ডিং আজ বিশ্বের কাছে উদাহরণ। খুব মজার কথা হলো কোনো বিদেশি বায়ার কিংবা সরকার আমাদের এই বিনিয়োগে শামিল হয়নি।
এখানে উল্লেখ করতে চাই, শুধু ফায়ার সেফটি ইকুইপমেন্ট শুল্ক ৫ শতাংশ রাখতে দুই বছরের বেশি সময় লেগেছে। এখন প্রশ্ন এই ৪০ বছরে এতোগুলো বিপর্যয় কিভাবে সামাল দিল গার্মেন্ট শিল্পের মালিকরা।
আমি কারো নাম উল্লেখ না করে বলতে চাই, যাদের হাত ধরে এদেশে গার্মেন্ট শিল্প গড়ে উঠেছিল, তাদের আজ ৯০ শতাংশ ব্যক্তিগতভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কেন মানুষ এ ব্যবসা করে? কারণ এই ব্যবসা থেকে বের হওয়ার আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেই।
আজ যখন বলছি তখন কতো আর্থিক লসের মাধ্যমে এই শিল্পের উত্তরণ হবে। তা কারো জানা নেই। আমরা শুধু জেনেছি সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। এই সাথে শ্রমিক কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন, বিদ্যুৎ গ্যাস, ব্যাংকের সুদ আরও দুই বিলিয়ন পর্যন্ত লস হবে। সব মিলিয়ে ছয় বিলিয়ন ডলার লোকসান হবে।
আজ কল্পনাও করতে পারছি না। ৪০ বছরে গড়ে ওঠা এই শিল্পের সঙ্গে মালিক কর্মচারী শ্রমিক সবার ভবিষ্যৎ। শুধু গার্মেন্ট শিল্পের বিপর্যই নয়। এর সাথে জড়িত বাংক, বিমা, হোটেল, ট্রান্সপোর্ট সব ব্যবসাই অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
আজ ইউরোপ আমেরিকা সমস্ত স্টোর এবং শপিংমলগুলো বন্ধ। তাদের ২ মাসের বেশি বন্ধ থাকলে পরবর্তী সিজনের চার মাস এই অবস্থা থাকবে। বিক্রি করতে পারবে না। সেই সাথে নতুন কোনো অর্ডারও সাপ্লাই চেইনে নাই। একদিকে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্ডার স্টক, নতুন কোনো অর্ডার সাপ্লাই চেইনে নাই। তাইতো ৯৫ শতাংশ বায়ারের ক্যাশ ফ্লো বন্ধ হয়ে যাবে। আমার ধারণা ৪০ শতাংশ বায়ার আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে না এবং তারা তাদের দেউলিয়া ঘোষণা করে বন্ধ করে দিবে।
সমস্ত সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হওয়ায় জন্য ৫০ শতাংশ যুব সমাজ চাকরি হারাবে। ফলে ইউরোপ আমেরিকায় ৩০/৪০ শতাংশ অর্ডার কমে যাবে। একই সাথে চাহিদা কমে যাওয়া ও রপ্তানি আমদানিকারক দেশগুলোর অর্থনৈতিক সখ্যতা কমে যাওয়ায় তৈরি পোশাকের চাহিদা ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সে হিসেবে আমাদের ১৫ লক্ষ শ্রমিক চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছে। শুধু শ্রমিকই নয়, বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ৫০ শতাংশ আছে যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে গার্মেন্ট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের কথা কেউ বলে না। তারা ইন্ডাটিস্ট্রয়াল ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিত মার্চেনডাইজার, প্ল্যানিং ইঞ্জিনিয়ার, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং টেক্সটাইল এবং ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। এই পাঁচ লক্ষ শিক্ষিত যুবকদের বেতন ৫শ ডলার থেকে ৮ হাজার ডলার। এই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেকার হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আজ যখন অনেক মালিক মহামারি পরিস্থিতিতে আইন মেনে লে অফ ঘোষণা করছে। তখন শ্রমিক নামধরী অনেক নেতা, যারা কোনো দিন শ্রমিক হিসেবে কোনো কারখানায় কাজ করেনি। তারাই মালিকদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করছে। অনেকে বলছে শ্রমিক ছাঁটাই বেআইনি। একটু ভেবে দেখুন একটি কারাখানায় যখন তিন মাসের উৎপাদন অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। যা দুই বছরের বেতনের সমান, তাহলে মালিকের কত টাকা জমানো আছে, সেই মালিক বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে পারবেন। আইন যদি তারা সমভাবে বেআইনি বলে তাহলে মালিক হওয়া কি অপরাধ? তাহলে মালিকরা কি মানুষ না?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণে সত্যিই বলেছেন: অন্ধকারের পরেই আলো। কিন্তু যে অন্ধকারে আজ গোটা পৃথিবী নিমজ্জিত। এই উত্তরণে দরকার সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। যাতে নতুন করে নতুনভাবে সবাই সবকিছু গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০২০