বর্তমান বিশ্বের আলোচিত মহামারির জন্য দায়ী করোনা ভাইরাসটি চীনের উহান শহরে প্রথম শনাক্ত হয়। পরবর্তী সময়ে এটি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
জীবজগতে দুই ধরনের ভাইরাস দেখা যায়। সাধারণত উদ্ভিদ ভাইরাসগুলি হয় আরএনএ (RNA) জিনোম বিশিষ্ট আর প্রাণি ভাইরাসগুলি হয় ডিএনএ (DNA) জিনোমিক। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি এইচআইভি কিংবা ডেঙ্গুর মত ব্যতিক্রমধর্মী ভাইরাস যাতে ধনাত্মক সিঙ্গেল স্ট্র্যান্ডেড আরএনএ (RNA) জিনোম থাকে। এতে ২৯৮৯১টি নিউক্লিওটাইড সিকুয়েন্স আছে যা জিন মিউটেশনে তার টিকে থাকা, সংক্রমণ কিংবা উগ্রতার তারতম্য নিয়ন্ত্রণ করে। এই আরএনএ (RNA) কে ঘিরে রাখা প্রোটিন আবরণ এবং তার বাইরের স্পাইক পোষক কোষে লেগে থাকা এবং সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষকদের মতে এটি মানুষের ন্যাচারাল ওপেনিং যেটি শ্বাসতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত। যেমন- নাক এবং মুখ দিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে। তবে চোখের এপিথেলিয়াল স্তর ভেদ করে প্রবেশের প্রমাণও বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা এবং বিশ্বব্যাপী সংক্রমণ মাত্রা বিবেচনায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটিকে প্যানডেমিক রোগ ঘোষণা করেছে। একটি মহামারি যখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তখন এটিকে প্যানডেমিক বা বৈশ্বিক মহামারি বলা হয়। ইতোমধ্যেই কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ দুই শতাধিক দেশে ছড়িয়েছে। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বে ৩০ লাখের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২ লাখের বেশি।
একটি মহামারি সংঘটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জীবাণুর উগ্রতা বা রোগোৎপাদন ক্ষমতা, সংবেদনশীল পোষক এবং উপযুক্ত পরিবেশ। এই তিনটি উপাদানের যে কোনোটির পরিবর্তনই মহামারির অবস্থায় পরিবর্তন আনে। ইমিউনো ডিফেন্স বিশেষজ্ঞ ও ভাইরোলজিস্ট ড. এলান রানড্রপ থমসন তার গবেষণাপত্রে ক্রমাগত জিন মিউটেশনের কারণে ভাইরাসটির রোগোৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। এছাড়া আমরা বলতে পারি, বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় কার্যকর প্রতিষেধক দ্রুত আবিষ্কারের মাধ্যমে রোগসংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব হবে। চীনের বিজ্ঞানী ওয়াং এবং তার সহ গবেষকগণ Remdesivir (RDV) কে সম্ভাব্য প্রতিষেধক হিসাবে গবেষণাগারে ট্রায়াল দিতে সক্ষম হয়েছেন।
চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশনের (NHC) মতে কোভিড-১৯ এর গড় সুপ্তিকাল ১০-১৪ দিন। এই সময়টা সংক্রমণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় লক্ষণ অপ্রকাশিত থাকলেও একজন থেকে অন্যজনের দেহে ভাইরাস স্থানান্তর হতে পারে। এজন্য এ ধরনের মহামারি নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হচ্ছে হিউম্যান ট্রান্সফার চেইন অকার্যকর করে দেওয়া। এটাকেই বিশ্বব্যাপী বলা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি, কার্যকর লকডাউনের পর এটি চীনে পতন পর্যায়ে চলে এসেছে। অর্থাৎ সংক্রমণ চেইন ভেঙে দেওয়ার সুফল তারা পেয়েছে। এছাড়া ভাইরাসের সম্ভাব্য ট্রান্সমিশন রোধে নাক, মুখ ও চোখের সুরক্ষা, বারবার জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার করা, সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং ব্লিচিং পাউডারের প্রয়োজন মাফিক ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সুরক্ষা এ সময় জরুরি।
বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক ধারণা ছিলো ভাইরাসটি নিম্ন তাপমাত্রায় অধিক সক্রিয় এবং নিম্ন রোগ প্রতিরোধক্ষম ও বয়স্কদের সহজেই কাবু করতে পারে। আমরা ইতালি কিংবা অন্যান্য দেশের মৃতের তালিকা দেখলে এর অনেকটা সত্যতা দেখতে পাই। যুক্ররাষ্ট্রের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান এমআইটির (MIT) গবেষক কাশিম বুখারীর গবেষণায়ও উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতায় কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কথা বলেছেন। ড. বুখারীর কথা সত্য হলে বলা যেতে পারে, আসন্ন গ্রীষ্মের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া করোনা বিস্তারে সহায়ক হবে না।
একটি মহামারির শুরু থেকে পতন পর্যন্ত চারটি পর্যায় থাকে। এগুলো হচ্ছে মন্থর পর্যায় বা প্রস্তুতি পর্যায় (Lag Phase), দ্রুত বৃদ্ধি/সূচক পর্যায় (Log Phase), শীর্ষ পর্যায় (Climax Phase) এবং পতন পর্যায় (Decline Phase)। প্রস্তুতি পর্যায়টিতে (Lag Phase) সাধারণত মন্থর গতিতে সীমিত সংক্রমণের ঘটনা ঘটে। এই পর্যায়টিতে কার্যকর ব্লক করতে পারলে পরবর্তী দ্রুত বৃদ্ধির পর্যায়টিতে প্রাণহানির সংখ্যা কমে আসে। ইপিডেমিওলোজি কার্ভ অনুযায়ী অধিকাংশ দেশে এটি দ্রুত বৃদ্ধির পর্যায়ে চলে এসেছে। কোথাও কোথাও শীর্য পর্যায়ে চলে গেছে। মহামারি শীর্য পর্যায়ে পৌঁছার কিছুদিন পরে নিশ্চিতভাবেই রোগের প্রকোপ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। চীনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই স্পষ্টতই এটি পতন (decline) পর্যায়ে চলে এসেছে। আমাদের দেশে বিশেষজ্ঞগণ আগামী দুই সপ্তাহকে গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন। মহামারি কার্ভ বিবেচনায় এ সময়টি দ্রুত বৃদ্ধি থেকে শীর্য পর্যায়ের সময়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই বৈশ্বিক মহামারির পতন কখন হবে। সংক্রমণের গতি প্রকৃতি দেখে এটা প্রতীয়মান হয় যে একসাথে এর পতন না হয়ে অঞ্চল বা দেশ ভিত্তিক ক্রমান্বয়ে হবে। নোবেল বিজয়ী জীববিজ্ঞানী মাইকেল লেভিটের মতে কোভিড-১৯ মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর ধরে ছড়িয়ে পড়বে না। ড. লেভিট ৭৮টি দেশের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই চীনে সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে কমে আসবে। সুতারাং বিজ্ঞানীদের মতামত বিশ্লেষণ করে স্পষ্টই বলা যায়, আতংক নয়, আমদের প্রয়োজন সুরক্ষার সচেতনতা, প্রয়োজন সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। সরকার ইতোমধ্যেই জীবাণুর সামাজিক বিস্তার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন। ফলে স্বল্প ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়েই মহামারির পতন হবে আমরা আশা করতে পারি। তবে এটি দিন তারিখ উল্লেখ করে বলার সময় এখনো আসেনি। বিজ্ঞানীদের নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা থেকে এটুকু বলাই যায় অতি দ্রতই সংক্রমণের হার কমে গিয়ে অন্ততঃ আমাদের দেশে মহামারির পতন ঘটবে, শিগগিরই মহামারি মুক্ত স্বদেশের মুক্ত বাতাসে আমরা ফেলবো স্বস্তির নিঃশ্বাস।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ