এই লকডাউন শুরু হতেই দেশের অসংখ্য দৈনিক আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জীবন জীবিকা এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। হকার, চালক, মিস্ত্রি, শ্রমিকসহ নানা পেশার মানুষ পড়েন অনিশ্চয়তায়।
এই সবগুলো কাজের জন্যই প্রয়োজন ছিল দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবীর। আমরা প্রচুর রেসপন্সও পাচ্ছিলাম, স্বেচ্ছাসেবীরা দেশের বিপদে বরাবরের মতো মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন, কাজ করতে চেয়েছেন। দেশের প্রতিটি দুর্যোগেই আমরা দেখি অনেক স্বেচ্ছাসেবক উদ্যোগী হয়ে মানুষকে সেবা দেয়। এখানে একটা সমন্বয় ও সুন্দর সমাধান বের করা ছিল মিশন সেভ বাংলাদেশ এর জন্য প্রাইমারি চ্যালেঞ্জ।
দুর্গত মানুষদের সাহায্য দেওয়ার কাজটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব স্বেচ্ছাসেবকরা এই কাজ করছেন, তাদের প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে সর্বোচ্চ। তাই ছোট ছোট টিমে, যতটুকু সাবধান থেকে কাজ করা যায়, করার চেষ্টা করেছি।
ত্রাণ পৌঁছানোর পরিবহন খরচ কমানোর জন্য চারটি পণ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা সমন্বয় করেছি তাদের লজিস্টিক ও পরিবহন সুবিধা ব্যবহারের জন্য। তাদের ওই সহায়তায় আমরা পরিবহন ও সেবা পৌছে দেওয়ার কাজটা নুন্যতম খরচে করতে পেরেছি। সেচ্ছাসেবাকে শুধুমাত্র ব্যক্তিপর্যায়ে না রেখে আমরা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিছু প্রতিষ্ঠান অনুদান, নিজস্ব পণ্য, স্বেচ্ছাসেবক ও পরামর্শ দিয়ে সাধ্যমত পাশে দাঁড়িয়েছে।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তরা সাধারণ কোনো রোগ নয়, সবচেয়ে ভয়ংকর হিসেবে ধরে নেওয়া রোগ ক্যান্সার এর চেয়েও এর ভয়াবহতা অনেক বেশি, ক্যান্সার কোনো সংক্রামক ব্যাধি নয়, আর করোনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটাই হচ্ছে সংক্রমিত হওয়ার আশংকা। এটি মোকাবিলার মূল কাজ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেডিক্যাল কর্মীদেরই করতে হবে, বাকিদের কাজ শুধুই সচেতনতামূলক। নিজেদের যতটা সম্ভব বিচ্ছিন্ন রেখেও এ ধরনের কাজ করা যায়, প্রয়োজনে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।
নিজেরা সুস্থ না থাকলে জনসেবা করাটাও মুশকিল, নিজেদের নিরাপদ ও সুস্থ রাখতে হবে। আমি কিছু পয়েন্টের ওপর আলোকপাত করতে চাই যেখানে স্বেচ্ছাসেবকরা ঘরে বসে নিরাপদ থেকেও দেশের জন্য কাজ করতে পারবেন।
১. ‘কিছুই হবে না’ কিংবা ‘সব ঠিক হয়ে যাব’ এমন একটা মনোভাব আছে গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে। তাদের সচেতন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যাতে সবাই ঘরে থাকেন এবং একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হন- এটি ব্যক্তি পর্যায় থেকে বোঝানো বা কাউন্সেলিং করা।
২. করোনা আক্রান্ত পরিবারের সবাইকেই সঙ্গত কারণে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে। তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়া যেতে পারে। কোনোক্রমেই যেন কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের বাইরে বের হতে না হয়, সেজন্য তাদের অব্যাহতভাবে সহযোগিতা দিয়ে যেতে হবে। নিজ এলাকায় ছোট টিম করে কাজটি করা যেতে পারে।
৩. প্রচুর মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে আছেন গৃহহীন ক্ষেতমজুর, দিন আনে দিন খাওয়া মানুষরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ছোটো দলে সাহায্য করা বা যাদের সাহায্য প্রয়োজন এই তথ্যগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ করে একটা ডাটাবেস তৈরির মাধ্যমে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ব্র্যাক, মিশন সেভ বাংলাদেশ বা বিদ্যানন্দের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়াটাও একটা বড় কাজ হতে পারে।
৪. ছোটো ছোটো টিমে নিজেদের ভাগ করে গণজমায়েতের সব স্থানে স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই পৃথিবী, এই দেশ, এই শহর বসবাসের জন্য উপযোগী করার পেছনে যে দায়িত্বগুলো আছে, আমরা ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সে দায়িত্ব এড়াতে পারি না। মিশন সেভ বাংলাদেশ ওই দায়িত্ববোধ ও যৌথ উদ্যোগের সফলতার দৃষ্টান্ত বহন করে। এই যুদ্ধটা আমাদের সবার, এই দেশটাও আমাদের সবার। একা বেঁচে থাকাটা বাঁচা হয় না। স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ অবশ্যই করতে হবে, কিন্তু নিজেদের, পরিবারের ও সমাজের মানুষকে নিরাপদ রেখে।
লেখক: মিশন সেভ বাংলাদেশের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০২০
এইচএডি/