শ্বেতশুভ্র লম্বা দাড়ি, সাদা শার্ট, মাথায় টুপি, স্নিগ্ধ নিষ্পাপ চেহারা! দেখতে তিনি যেন এক বুজুর্গ আলেম দরবেশ আল্লাহভীরুই নন, হালাল তরিকায় রুটি-রুজিতে জীবিকা নির্বাহ করা শতভাগ সরল এক সৎ মানুষ। ছবি দেখে ভেবেছিলাম র্যাব হয়তো কোনো আলেমকে নিরাপত্তা দিচ্ছে।
আমি র্যাবের হাতে আটক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক অঢেল অবৈধ অর্থসম্পদের মালিক বনে যাওয়া আবদুল মালেক ওরফে বাদলের কথা বলছি। এখন আর পোশাকে চেহারায় ভালো মানুষ চেনা যায় না! এখন আর ধর্মীয় পোশাক নামাজ হজে মশগুল কাউকে দেখলেই আল্লাহর নেক বান্দা বলে বিশ্বাস করা যায় না। সব লেবাসের আড়ালেই আমাদের চারপাশে বাস করে চোর, ডাকাত, লোভী কদর্য সব মানুষ। লুটেরা অর্থ পাচারকারী আর দুর্নীতির মোগলরা। মালেককে র্যাব ধরার আগে না মিডিয়া না মানুষ কেউ তার খবর জানল না!
এমন লজ্জা সবার জন্যই গ্লানির। গণমাধ্যমকেও এখন সারাদেশের লুটেরা, দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খোলার সময়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাড়ানো দরকার। দুদক তাকে দুবার ডেকেও ওপরের চাপেই হোক আর নিজেদের দুর্বলতায়ই হোক কিছুই করতে পারেনি। দুদক কত ছোট লুটেরাকে ধরে আবার ওপরের চাপে সাদা বানিয়ে মুক্তি দেয়। সাবেক দুদক চেয়ারম্যান যথার্থই বলেছিলেন, দুদক এক নখদন্তহীন বাঘ।
দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান কথায় ব্যক্তিত্বে আস্থা অর্জন করেছিলেন। রিলিফ ও গম চুরির অভিযোগে মেম্বার, চেয়ারম্যান ছাড়া কী ধরেছেন? এত অর্থ বিদেশে পাচার হলো, ব্যাংকে ও শেয়ারবাজারে সীমাহীন লুটপাট হলো। ঘুষ, দুর্নীতিতে কতজন সারাদেশে অবৈধ অর্থসম্পদের মালিক হলো তার কটা ধরেছেন? একটা রাঘববোয়াল ধরেছে দুদক? দেশে দেশে অর্থপাচার করা বেগমপাড়ার বাসিন্দারা কেন পাকড়াও হয় না? তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয় না? গাড়িচালক মালেকের বিশাল সম্পদসহ নানা অপরাধে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে র্যাব আটক করেছে। স্বাস্থ্যের কর্মচারী আবজাল ১ হাজার ৫০০ কোটি কামিয়ে এখন জেলে। তাদের সিন্ডিকেটের গাড়িচালক মালেকই যদি এত সম্পদ বানিয়ে থাকেন, তাহলে পরিষ্কার যে, গোটা স্বাস্থ্যখাতের বিশাল হরিলুটে টপ টু বটম কি নির্লজ্জ দুর্নীতিগ্রস্ত! ওপরের কর্তাদের দুর্নীতির আশকারায় কর্মচারী আবজাল, ড্রাইভার বাদল এমন দাপুটে লুটেরা হন। এদের জন্য আবার সাহেব-বিবির অন্দরমহল খোলা থাকে বাণিজ্যের দফারফায়!
এরা লেবাস পরে ধর্মপ্রাণ মুসল্লি আলেম-ওলামা আর সংখ্যাগরিষ্ঠ সৎ মানুষের অবমাননা করেন। দেশের জনগণ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে সততার সঙ্গে। সন্তান মানুষ করা, চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে হিমশিম খায়। রাজনীতি থেকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কত মানুষ কত সংগ্রাম করে। দেশে বিনিয়োগকারী শিল্পপতি থেকে খুদে ব্যবসায়ী উদয়াস্ত যুদ্ধ করে আর একদল অসভ্য চোর, ডাকাত বেহায়া হারামখোর সারাদেশে নির্লজ্জের মতো লুটপাট চালায়। এদের বাবাদের ধরা হয় না বলে বহালতবিয়তে দাপটে জীবনযাপন করে।
মালেক রাজধানীর হাতিরপুলে ৪ কাঠা জমির ওপর ১০ তলা এবং তুরাগে ৬ কাঠা জমিতে সাত তলার দুটি ভবন, ২৪টি ফ্ল্যাট, অঢেল টাকা, দুই স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও ভাইয়ের নামে গড়েছেন আরও অঢেল সম্পত্তি। নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, কাজ পাইয়ে কমিশন লাভ, জাল টাকার বাণিজ্য, অস্ত্র-বাণিজ্য, অস্ত্রবাজি, কী করেননি আটক স্বাস্থ্যখাতের এইট পাস গাড়িচালক ডন মালেক? মালেকরা আজ গোটা মূল্যবোধহীন দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজের একজন খুদে মডেল মাত্র। যারা গর্ব করে বলেন, দুর্নীতি করাও একটা যোগ্যতা তাদের আইডল। যারা যেনতেন উপায়ে টাকা কামালেই বলেন, ট্যালেন্ট, তাদের নষ্ট সমাজের কালো মুখ মালেক। ছোট বড় কত সহস্র মালেক আজ দেশটা গিলে খাচ্ছে! লোভের বিষে বিষাক্ত করেছে সমাজকে।
এখন আর গজনির সুলতানদের শত শত মাইল বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে সোমনাথ মন্দির লুট করে সম্পদ গড়তে হয় না। রাজদুর্নীতির এ যুগে দেশের স্বাস্থ্যখাতের গাড়িচালক মালেক থেকে কর্মচারী আবজালরাই শত শত কোটি টাকার সম্পদ লুট করে বহাল তবিয়তে থাকেন। মাঝেমধ্যে ধরা পড়ে কেউ কেউ। কত লুটেরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে! মালেক, আবজাল, জিকে শামীমরা একেকজন আজ গজনির সুলতান। আর দেশটাকে তারা বানিয়েছেন সোমনাথ মন্দির। সোমনাথ মন্দিরে গজনির সুলতান লুটেছিলেন হিন্দু রাজাদের গোপন সম্পদ। আর এরা লোটেন দেশের সম্পদ। এদের মধ্যে অনেকে রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রকৌশলী, ডাক্তার, মধ্যস্বত্বভোগী, তদবিরবাজ, দালাল, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, গণমাধ্যমের একাংশও রয়েছে। সারাদেশে এদের বিচরণ। হরিলুট করছে। এমন কোনো সরকারি অফিস নেই যেখানে দুর্নীতির ঘা নেই।
মালেক কি দেশে একজন? এদের গডফাদার কি একজন? এরা কি এক দিনে তৈরি হয়েছে? বছরের পর বছর সব সরকারের আমলে এরা তৈরি হয় দুর্নীতির ছায়ায়। বিএনপি জমানায় হাওয়া ভবনের ছায়ার বাইরেও কি তৈরি হয়নি? সোনালী ব্যাংকের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কর্মচারী বাকিরের কথা মনে পড়ে? ওয়ান-ইলেভেনে আটক হয়ে মারা যান কারাগারে! কি দাপট ছিল তার রাজনৈতিক প্রভাবে। বনের রাজা ওসমান গণির তোশকজুড়ে কেবল টাকা আর টাকা। তিতাসের মিটার রিডার থেকে শিল্পপতি হওয়া সেই ধনাঢ্য চোরটা?
এখানে জনগণের উন্নয়নের টাকা, ট্যাক্সের টাকা, ভ্যাটের টাকা, প্রবাসী শ্রমিকের ঘামে ঝরা রেমিট্যান্সের টাকা, বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের টাকা কৃষক-শ্রমিকের হাড় ভাঙা পরিশ্রমের টাকা, সরকারের জনকল্যাণে নেওয়া প্রকল্পের টাকা সব। এখানে লুটেরাদের সৈন্যবাহিনী লাগে না। সিন্ডিকেট লাগে। যার যার সেক্টরে ওপরের কর্তাদের প্রশ্রয়-আশ্রয় ভাগাভাগি লাগে। অর্থের নেশায় পদপদবির মর্যাদা ভুলে এরা ড্রাইভার, কর্মচারীর সঙ্গে রুচিহীনতায় নির্লজ্জের ভাগাভাগি করে।
গজনির সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত অভিযান করেছিলেন। সে সময় তাকে অপ্রতিরোধ্য শক্তি বলা হতো। ১০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে ৪২ দিনে সৈন্যসামন্ত নিয়ে গজনি থেকে গুজরাটের সোমনাথ মন্দির অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। তার বিভিন্ন অভিযানে স্থানীয় হিন্দু রাজাদের পরাজিত করার খবর যেমন রয়েছে, তেমনি সেই রাজাদের সোনা, হীরা এ মন্দিরে গচ্ছিত রাখার খবর আছে। ইতিহাসের সত্য হচ্ছে, সোমনাথ মন্দির থেকে সে অভিযানে গজনির সুলতান ২০০ মণ সোনা লুট করে তার দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মালেক এলাকায় রীতিমতো মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস মালেক ১৯৮২ সালে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পে চালক হিসেবে যোগদান করে ’৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে চালক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে প্রেষণে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত।
মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেন একা যুদ্ধ করবেন; আর কারও দায় নেই। তিনি যাদের যত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের কি নিজেদের ভালো থাকা আর না হয় সব দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, ঘুষখোরকে পাহারা ও প্রশ্রয় দেওয়া দায়িত্ব? ক্যাসিনো-বাণিজ্য থেকে জিকে শামীমদের একচেটিয়া টেন্ডার-বাণিজ্য, পাপিয়া, সাহেদ, সাবরিনা, জেমির মতো প্রতারক এমনকি ফরিদপুরের ছাত্রলীগ সভাপতিসহ কয়েকজনকে ২ হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ে আটক তাকেই করতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে। এক ফরিদপুরে যদি এমন হয় তাহলে সারাদেশের সব জেলায় কতজন দুর্ধর্ষ অপরাধী অবৈধ অর্থ-বাণিজ্য সম্পদের অঢেল মালিক আজ? এক স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যদি মিঠু-আবজাল-মালেক সিন্ডিকেটে দুর্নীতিতে অভিশপ্ত হয় তাহলে বাকি সব প্রতিষ্ঠান কোনটা কত অন্ধকার বীভৎস? জনগণের সম্পদ লুটেরাদের আইনের আওতায় এনে সব অবৈধ সম্পদ কেন বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নেওয়া হয় না। প্রয়োজনে বিশেষ আদালত ও আইন দরকার। এদিকে সব মন্ত্রী, এমপি, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদেরও কঠোর বার্তা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতিবিরোধী চলমান অভিযান আরও শক্তিশালী করা দরকার। গণজাগরণও দরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে। গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও অভিনন্দন জানাতে হয়।
মালেক কেবল ড্রাইভারদের নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতির নামে হাতিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডাক্তারদের বদলি, পদোন্নতি, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগের নামে বিপুল অর্থ আদায় করেছেন মালেক। মন্ত্রী থেকে কর্মকর্তারা কি তখন আঙুল চুষছিলেন? দায় তাদের নিতে হবেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মেয়ে নওরিন সুলতানাকে কম্পিউটার অপারেটর, ভাই আবদুল খালেক ও ভাতিজা আবদুল হাকিমকে অফিস সহায়ক, বড় মেয়ের স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার, আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক, ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার এবং ভাগ্নে সোহেল শিকারীকে ড্রাইভার পদে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরি দিয়েছেন। বর্তমানে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে তিনি কর্মরত। তবে নিজে গাড়িচালক হয়েও মহাপরিচালকের পাজেরো গাড়িটি হরহামেশাই ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। এতসব অপকর্ম কেন করতে দেওয়া হতো তা দুধের বাচ্চারও বোঝার কথা। কতটা যন্ত্রণায় মালেক আটকের পর একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ডিজি হয়ে মরতে চাই না, ড্রাইভার হয়ে মরতে চাই!
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মালেকের অন্যতম আশ্রয়দাতা হিসেবে একাধিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গেও তার দহরম-মহরম ছিল। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কবির হোসেন চৌধুরী ছাড়াও বিএমএ ও স্বাচিপের কয়েকজন নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শাহ মনির হোসেনের আমলে গাড়িচালক মালেক একাই শতাধিক নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন। কি ভয়ঙ্কর রুচিহীন কর্তাদের দুর্নীতি। সবাইকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
এ দেশে যত গালি রাজনীতিবিদদের জন্য। জেল নির্যাতন তাও রাজনীতিবিদ। সমালোচনা নিউজ রাজনীতিবিদদের কপালেই। সেটা হোক। রাজনীতিবিদ মানুষের নেতা, ভুল করলে খেসারত দেবেন। কখনো তালি কখনো গালি খাবেন। তাদের ব্যর্থতায় আজ এ অবস্থা। তাই বলে সব পাবলিক সার্ভেন্ট বা আমলারা কি ধোয়া তুলসীপাতা! সারা জীবন সব সরকারের আমলে ব্রিটিশের তৈরি আইনের ম্যাকিয়াভেলির আমলাতন্ত্রের প্রভুর আসনে আরামে রাজত্ব করেন। অবসরের শেষে জোটে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। সেটার সময় শেষ হলে আবার কপালে জোটে ফের দীর্ঘ নিয়োগ। কখনো আরেক ধাপ এগিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হয়। হোক নির্বাচন কমিশন বা পাবলিক সার্ভিস কমিশন। অবসরে গিয়েও তারা কর্মক্ষম। এরপর এমপি, মন্ত্রীও হন! অন্যদিকে সরকার বদল হলেই রাজনীতিবিদদের জন্য জেলসহ কত নির্যাতন-নিপীড়ন, অসম্মান। তবু রাজনীতিবিদরা জনগণের সমর্থন থাকার পরও ক্ষমতায় থাকতে এটা মনেও রাখেন না!
আমলারা ভোগ করেন জনগণের টাকায় বাড়তি বিলাসী জীবন। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ সংগ্রামের রক্তঝরা সিঁড়িপথে সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের যে মর্যাদা ও ক্ষমতা দিয়েছিলেন আজ তা কারও মনেও নেই। সামরিক শাসকরা যা করতে পারেননি গণতন্ত্রের যাত্রাপথে ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে যে রাজনৈতিকীকরণ দৃশ্যমান হয় সেটি ২০০১ সালের পর থেকে দলীয়করণের প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করে।
এরপর থেকেই পাবলিক সার্ভেন্ট আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন, সরকারি দলের অনুগত কর্মীতে পরিণত হন। বিগত ১১ বছরে তো সবাই আওয়ামী লীগ অন্য পেশাজীবীদের মতো। ’৭৫-পরবর্তী তাদের ছাত্র রাজনীতির দর্শনেও কারও কিছু আসে যায় না। এক কথায় সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। তারা রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের নন, তাদের সিন্ডিকেটের বড় সাহেবদের হিসাবে চলেন। এখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসীম ক্ষমতাধর। পাবলিক সার্ভেন্টরা জনগণ যে ক্ষমতার মালিক তা ভুলে গিয়ে নিজেদের কিংমেকারই নন, ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক মনে করছেন।
মনে হয় এত মোটা বেতন, এত সুযোগ-সুবিধায় তারা আরও বেপরোয়া। অনেকে ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার করছেন যে বলার মতো নয়।
বিসিএস প্রশাসনে সরকারি কর্মকর্তাদের পদ না থাক, পদোন্নতি আছে। কর্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ছেই। উপসচিব পর্যায়ে গাড়ি কেনায় ঋণ মেলে। ৪ শতাংশ সুদে সরকারি কর্মকর্তাদের বাড়ি করতে ঋণ পাবেন। জনগণ এর পরও ক্ষমতার মালিক, তারা পাবলিক সার্ভেন্ট নাকি প্রহসন? করোনাকালে ফ্রন্টলাইনে না থেকেও আর্থিক সুবিধা পেয়েছেন অনেকে। বেতন এত বাড়লেও নতুন পে-স্কেলের দাবি তুলছেন। চারজন সচিব মুক্তিযোদ্ধা হতে গিয়ে ধরা পড়ে হতে পারেননি। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বা প্রতারণা মামলায় শাস্তিও নেই। অনেকে জাল সনদ নিয়ে চাকরির বয়সসীমাও বাড়িয়েছেন। ঘোড়াঘাটের ইউএনওর ওপর হামলা জঘন্য। তার বাড়িতে পাওয়া এত নগদ টাকা রহস্যময় তদন্তের।
ক্ষমতার মালিক জনগণকে যখন-তখন কোমরে রশি বেঁধে আনা যাবে, কিন্তু পাবলিক সার্ভেন্টকে ধরতে, মামলা করতে বিভাগীয় অনুমতি লাগে। রাজনীতিবিদদের রোজ দল আইন ও জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়। সারা জীবন দলের আদর্শে আপসহীন থাকলেও কপালে কত দ- জোটে। ক্ষমতার পালাবদলে পাবলিক সার্ভেন্টরাও চরিত্র বদলে বহালতবিয়তে থাকেন। কিন্তু তাদের কাজ হওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের প্রতি, রাষ্ট্রের মালিক জনগণের প্রতি অনুগত থেকে সরকারের কর্মসূচি পেশাদারিত্বে বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখা। সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে না যাওয়া। অতীতে তাই ছিল। দেশে দেশে এখনো আছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শেখ হাসিনার সরকার বেতন-ভাতা বৃদ্ধি থেকে এত সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন তার পরও সরকারি খাতেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি কেন? এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
আমলারা হাঁসের মতো মাছটা খেয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে কাদা মুছে চলেন। তাদের পরীক্ষা নেই। কে কোথা থেকে এলেন জানারও দরকার নেই। রাজার হালে নিরাপদ জীবন। আহারে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আফসোসে যথার্থই বলেছিলেন, রাজনীতি করলে বিসিএস পাস করেই, ইঞ্জিনিয়ার হয়েই, ডাক্তার হয়েই রাজনীতি করুন। চাকরি করে অবসরে গিয়ে কেন? আর আমি বলি অবসরে যাওয়ার পরও জনগণের টাকায় তাদের ক্ষমতার আসনে কেন দীর্ঘদিন বসানো হবে? এটা রেওয়াজে পরিণত করা হচ্ছে কেন? আমলাদের এমন সুসময় অতীতে কখনো আসেনি, আসবেও না। দুর্ভাগ্য যে, ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের শাসনামলেই তারা যা চান তা-ই পান। আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুজিবকন্যার চলমান সংগ্রামে সব মহলকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী না হলে দুর্নীতিবাজ, ডাকাতরা আরও বেপরোয়া উন্মাদ হবে। দেশটাকে লুটপাট করে ফোকলা বানিয়ে ছাড়বে। দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে চাইলে সব দুর্নীতিবাজ অপরাধীকে রুখতেই হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০
টিএ