ঢাকা, সোমবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কৃষ্ণের বংশ পরিচয়, জন্মবৃত্তান্ত এবং...

 নান্টু রায়, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০২১
কৃষ্ণের বংশ পরিচয়, জন্মবৃত্তান্ত এবং...

বহুদিন ধরে এ উপমহাদেশে কৃষ্ণকে অনৈতিহাসিক এক পৌরাণিক চরিত্র বলে প্রতিপন্ন করার সচেতন প্রয়াস ছিল। বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমীকে ছুটি ঘোষণা করে সরকার কৃষ্ণের জন্মের ঐতিহাসিকতা স্বীকার করে নিয়েছেন, এটা কৃষ্ণপ্রেমীদের এক বড় অর্জন।

এজন্যে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।

আমরা জানি, দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ অধর্মের বিপরীতে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য মথুরার রাজকন্যা দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মথুরা উত্তরভারতের একটি প্রসিদ্ধ স্থান, আজও তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। কৃষ্ণ যেদিন জন্ম নিলেন, সেদিন ঘোর ঝড়জল- ভাদ্রমাসের রেবতীনক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। এই পবিত্র জন্মক্ষণকে সনাতনধর্মাবলম্বীরা কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে জন্মাষ্টমী হিসেবে উদ্যাপন করে আসছে। তখন আধুনিক ক্ষণগণনা কিংবা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তিত হয়নি, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান ভারতীয়দের এতটাই বৃৎপত্তি ছিল যে, তারা নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে অভ্রান্ত ক্ষণগণনা করতে পারতেন। যেমন ধরুন, কৃষ্ণের জন্মক্ষণটির কথা। বলা হচ্ছে, ভাদ্রমাসের রেবতীনক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি- ভাদ্রমাসে রেবতীনক্ষত্র কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে বছর ঘুরে একবারই আসে, পলমাত্র এদিক-ওদিক হবার যো নেই। সেই হিসেবমত নানা ঐতিহাসিক মাপকাঠি পর্যালোচনা করে বলা হচ্ছে, কৃষ্ণের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ সালে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় তিনি সত্তরোর্ধ্ব এক পরিণত প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব।

তাঁর পিতার নাম বসুদেব। সেজন্য তিনি বাসুদেব। কৃষ্ণ যদুবংশে জন্মগ্রহণ করেন। মহাভারতে পুরুরবা ঐতিহাসিক চন্দ্রবংশীয় রাজা। উর্বশীর সংসর্গে তাঁর আয়ু নামে এক পুত্র জন্মে। আয়ুর পুত্র নহুষ। নহুষের পুত্র যযাতি। যযাতির পাঁচপুত্র- জ্যেষ্ঠ যদু, কনিষ্ঠ পুরু। যযাতির জ্যেষ্ঠ চারপুত্র তাঁর আজ্ঞা পালন না করায় তিনি পুরুকে রাজ্যাভিষিক্ত করেন। এই পুরুর বংশে দুষ্মন্ত, ভরত, কুরু এবং অজমীঢ় প্রভৃতি ভূপতিরা জন্মগ্রহণ করেন। দুর্যোধন-যুধিষ্ঠির কৌরবেরা এই পুরুর বংশ, এবং কৃষ্ণ প্রভৃতি যাদবেরা যদুর বংশ। যযাতিপুত্র যদু থেকে মথুরাবাসী যাদবদের উৎপত্তি, পুরাণেতিহাসে এমনই বলা হয়।  

মহাভারত-পরবর্তী হরিবংশের হরিবংশপর্বে যে যদুবংশের কথা বলা হয়েছে, তা যযাতিপুত্র যদুরই বংশকথন। কিন্তু হরিবংশের বিষ্ণুপর্ব অনুসারে ইক্ষ্বাকুবংশীয় হর্যশ্ব ছিলেন অযোধ্যার রাজা। তিনি মধুবনের রাজা মধুর কন্যা মধুমতিকে বিয়ে করে কোনও কারণে মধুবনে বসতি করেন। এই মধুবনই মথুরা। এরই পুত্র যদু। যদুর পুত্র মাধব, মাধবের পুত্র সত্ত্বত, সত্ত্বতের পুত্র ভীম। মধুর পুত্র লবণকে রামের ভাই শত্রুঘ্ন পরাজিত করে তাঁর রাজ্য দখল করে মথুরানগর নির্মাণ করেন। হরিবংশ বলছে, রাঘবেরা মথুরা ত্যাগ করলে ভীম তা পুনরায় অধিকার করেন এবং এই যদুর বংশই মথুরাবাসী যাদবগণ।

আবার মহাভারত-পূর্ববর্তী ঋগ্বেদসংহিতার ১০ম মণ্ডলের ৪৮-৪৯ সূক্তে যযাতি, পুরু. যদু, তুর্বসুর নাম আছে। ১০ম মণ্ডলের ৬২ সূক্তে আবার ১০ ঋকে যদু ও তুর্বা (তুর্বসু) দাসজাতীয় রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ মণ্ডলের ৪৯ সূক্তের ৮ ঋকে ইন্দ্র তুর্বসু ও যদুকে বলবান এবং ৩ ঋকে আর্য বলে চিহ্নিত করেন। এতে বোঝা যায় না, যদু আর্য না অনার্য। আবার প্রথম মণ্ডলের ৩৬ সূক্তের ঋকের ঋষি অগ্নির দ্বারা তুর্বসু, যদু ও উগ্রদেবকে আহ্বান করেছেন। ’ আর্য ঋষি অনার্য রাজাকে দেবতার সম্মান দেবেন, এমন কি সম্ভব? 

যাহোক, এ পর্যন্ত আমরা তিনজন যদুর কথা পেলাম- ১. যযাতিপুত্র; ২. ইক্ষ্বাকুবংশীয় এবং ৩. অনার্য রাজা।

কৃষ্ণ কোন্ যদুর বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার মীমাংসা করা কঠিন। তবে, তাঁদের যখন মথুরা ছাড়া পাইনি এবং ঐ মথুরা ইক্ষ্বাকুবংশীয়দের নির্মিত, তখন যাদবেরা ইক্ষ্বাকুবংশীয় নন, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না।

যে যদুবংশেই কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করুন না কেন, সেই বংশে মধু, সত্ত্বত, বৃষ্ণি, অন্ধক, কুকুর ও ভোজ প্রভৃতি রাজারা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই বৃষ্ণি, অন্ধক, কুকুর ও ভোজবংশীয়রা একত্রে মথুরায় বাস করতেন। কৃষ্ণ বৃষ্ণিবংশীয়। কংস ও দেবকী ভোজবংশীয়। কংস ও দেবকীর এক পিতামহ।

কংসের পিতা উগ্রসেন ছিলেন যাদবদের রাজা। তাঁর রাজ্যের নাম মথুরা। কৃষ্ণের পিতা বসুদেব, মা দেবকী। কংস ছিলেন ভীষণ উচ্চাভিলাষী। ইতোমধ্যে তিনি পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজেই রাজা হয়েছেন এবং ক্রমে অতিশয় দুরাচারী হয়ে উঠেছেন। তিনি যাদবদের ওপর এমন পীড়ন শুরু করেন যে, অনেকে ভয়ে মথুরা থেকে পালিয়ে অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। বসুদেব তার আরেক পতœী রোহিণীকে যমুনা নদীর অপর তীরে অবস্থিত গোকুলনগরের ঘোষপল্লীতে নন্দ নামে এক গোপ ব্যবসায়ীর গৃহে রেখে এসেছিলেন। তিনি বসুদেবের আত্মীয়। সেখানে রোহিণী এক পুত্রসন্তান প্রসব করেন, সেই পুত্রের নাম বলরাম।

উৎপীড়কমাত্রই কাপুরুষ। কাজেই কংস ভেবেছিলেন, যাদব বংশের যে-কোন পুরুষ সন্তানই তাঁর জন্য বিপদের কারণ। বিবাহের পর প্রীতিবশত বসুদেব ও দেবকীর রথচালনা করলেও কংস আশংকা করেছিলেন, এঁদের গর্ভের সন্তানও তাঁর জন্য একদিন বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। সে-জন্য তিনি তাঁদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং কারাগারে জন্মগ্রহণকারী তাঁদের একের পর এক সন্তানকে কারাগার থেকে নিয়ে হত্যা করেন। এভাবে তাঁদের প্রথম ৬ সন্তানকে কংস হত্যা করলেন। সপ্তম গর্ভের সন্তান গর্ভেই বিনষ্ট হয়েছিল। দেবকীর অষ্টম গর্ভে শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হলেন। সেটি ছিল রোহিণী নক্ষত্রযুক্ত ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথির রাত। সেদিন ঘোর ঝড়জলে দশদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। বসুদেব কংসের দ্বারা প্রাণসংশয় হতে পারে আশঙ্কা করে সদ্যোজাত পুত্রকে রাতের অন্ধকারেই সেই ঝড়জলের মধ্যে যমুনার অপরপারে নন্দের গৃহে রেখে এলেন। সদ্য সন্তান হারানো যশোদাও তাঁকে পেয়ে পুত্রবোধে লালন-পালন করতে লাগলেন। সেখানে কৃষ্ণ ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন।

অধুনা কৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন লীলা এবং শ্রীরাধাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু সমালোচনাকালে আমরা ভুলে যাই যে, কৃষ্ণ যখন বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় যান, তাঁর বয়স দশ পেরিয়েছে। একাদশবর্ষীয় এক নওলকিশোরের পক্ষে কতটুকু লীলা সম্ভব, সচেতন পাঠককে ভেবে দেখতে বলি। যে রাধাকে নিয়ে এত বিতর্ক, যে রাধাকে নিয়ে ভারতবর্ষ বিশেষত বাংলা মাতোয়ারা, সেই রাধার উল্লেখ কিন্তু মহাভারতের কোথাও নেই। অর্থাৎ কৃষ্ণের জীবনের আদিমতম বিশ্বস্ত ইতিহাসে রাধা অনুপস্থিত। এমনকি বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ বা ভাগবতেও নেই। আছে শুধু ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর জয়দেবের কাব্যে। আদিম ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অবশ্য পাওয়া যায়নি। যেটা পাওয়া গেল, সেটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক আর এর রচনাকাল দশম-একাদশ শতাব্দী। এই সময়কালটা বিতর্কিত। আজ সে-বিতর্ক উহ্য থাক।

[বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র-এর আলোকে]

লেখক: ট্রাস্টি, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।