ঢাকা: দ্রব্যমূল্য, মজুরি কমিশন, জাতীয় বেতন স্কেল, ন্যূনতম মজুরি, শ্রম পরিস্থিতি ও চলমান ১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ও সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদ আয়োজিত জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী কনভেনশনে ৩২টি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল হাইস্কুলের সামনে অনুষ্ঠিত এই কনভেনশনের সমন্বয়ক ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস লিখিত বক্তব্যে এসব প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী কনভেনশনে ৩২টি প্রস্তাবনা হলো -
১. আজকের শ্রমিক কনভেনশনের লক্ষ্য সব ধরনের শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পূরণ করা হবে তাদের বেতন-ভাতা, ছুটিসহ অন্যান্য মৌলিক দাবি। শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
২. শ্রম আইন সংশোধন ও যুগোপযোগী করা। আগামীতে বাতিল করা হবে অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিল, শ্রম আইনসহ ২০১৮ সকল কালা কানুন বাতিল করে যুগ-উপযোগী করা। ভবিষ্যতে শ্রমিকদের মতামতের প্রাধান্য থাকবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে থাকবে শ্রমিকদের অংশীদারত্ব।
৩. ভবিষ্যতে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মালিক-শ্রমিক এবং সরকারের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হবে, গঠন করা হবে বিশেষ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল।
৪. শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করা হবে আর সেজন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, সড়ক পরিবহন অথবা সেন্ট্রাল ফান্ডকেন্দ্রিক একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা হবে।
৫. শ্রমজীবী অন্তঃসত্ত্বা নারী, অসুস্থ শ্রমিক, দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিক এবং বেকার শ্রমিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। মাতৃত্বকালীন সুবিধার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা হবে।
৬. প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য আলাদা রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেওয়া হবে, নিশ্চিত করা হবে আলাদা আইডি কার্ড। এটি তাদের হেলথ ও রেশন কার্ড হিসেবে কাজ করবে।
৭. অপ্রচলিত খাতের শ্রমিকদের প্রচলিত খাতের শ্রমিকদের মতো আনুপাতিক হারে সুযোগ- সুবিধা দেওয়া হবে।
৮. অসংগঠিত, অনিবন্ধিত শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠিত এবং চিহ্নিত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। শ্রমদপ্তর কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন ও আইডি কার্ড প্রদান করা হবে। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
৯. প্রত্যেক রেজিস্টার্ড শ্রমিকের কাজের ব্যবস্থা করা হবে। কাজের সংস্থান না হওয়া পর্যন্ত ন্যূনতম হারে হলেও শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে সম্মানজনক ভাতা দেওয়া হবে।
১০. ডিউটিরত অবস্থায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে তার পরিবারকে আই এল ও কনভেনশন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন ভাতা দেওয়া হবে। পরিবারে কর্মক্ষম কেউ থাকলে তাকে ওই স্থানে কাজের সুযোগ দেওয়া হবে।
১১. শ্রমিকদের মধ্য থেকে, তাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
১২. সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হবে।
১৩. শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক ইস্যুতে শ্রমিকদের ছেলেমেয়েকে বিশেষ অধিকার দেওয়া হবে কিংবা এ সংক্রান্ত ভাতা প্রদান করা হবে। দরকার হলে বাস্তবতা বিবেচনা করে সরকার তাদের দায়িত্ব নেবে।
১৪. চা শ্রমিক থেকে শুরু করে হোটেল, দোকান, নিরাপত্তাকর্মী, গৃহকর্মী, হকার, কুলি-মজুর কিংবা এ ধরনের সব শ্রমিকের জীবনধারণের উপযোগী মজুরি নিশ্চিত করা হবে।
১৫. শ্রমিকদের ওপর হয়রানি, নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধ করা হবে এবং নিত্য পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের চাঁদা আদায়ের সিন্ডিকেটকে ভেঙে দেওয়া হবে এবং বন্ধ করা হবে।
১৬. দেশ ও দশের স্বার্থে তথা আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সর্বক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।
১৭. ইউএনআইএলও কিংবা অন্যান্য শ্রমিক অধিকার সংশ্লিষ্ট কনভেনশনে অংশগ্রহণকারী দেশ হিসেবে তাদের নির্দেশনা মেনে চলবে।
১৮. দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে শ্রমিকদের জন্য মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে। বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারি তদারকি জোরদার করা হবে।
১৯. শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য স্থায়ী পে-কমিশন, মজুরি কমিশন গঠন করা হবে।
২০. বন্ধ সকল শিল্প কল কারখানা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
২১. খাতভিত্তিক শ্রমিকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে, সৃষ্টি করা হবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র।
২২. সরকারি নীতিমালা, বাজেট প্রণয়ন কিংবা এ ধরনের কার্যক্রমে শ্রমিক প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।
২৩. বাংলাদেশে প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী প্রবাসী শ্রমিকরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার। এসব নির্যাতন বন্ধ করে তাদের কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ও কল্যাণ তহবিলকে সহজলভ্য করা হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী যোদ্ধা হিসেবে দেওয়া হবে সম্মানসূচক স্বীকৃতি।
২৪. শ্রমিক আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, নির্যাতিত-নিপীড়িত শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে এবং যৌক্তিক ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করা হবে।
২৫. কৃষি ও শিক্ষা খাতে উন্নয়ন ঘটিয়ে কর্মক্ষেত্রের প্রসার ঘটানো হবে। সেসব ক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী শ্রমিকদের কাজ দেওয়া হবে।
২৬. শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ আর কারিগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। বাস্তবতা বিবেচনা করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও পরিধি বাড়ানো হবে।
২৭. প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিমারি কিংবা করোনার মতো মহামারিকালে শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ক্লাইমেট উদ্বাস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া নদীভাঙা মানুষদের জেগে ওঠা চরাঞ্চল বরাদ্দ দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে।
২৮. ইনফরমাল বা অপ্রচলিত খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবনমান সম্পূর্ণভাবে মালিকদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রে মালিকরা আইনকানুনের তোয়াক্কা করেন না। ভবিষ্যতে সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদ (এসএসপি) ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল এ অবস্থার পরিবর্তনে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।
২৯. জিডিপির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের কাজ, পরিচারিকা, গার্মেন্টস, কৃষি খাত, চাতাল, নির্মাণ খাত, হাঁস-মুরগি প্রতিপালনসহ ৫৮ শতাংশ খাতে নারীরা নানাভাবে অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মজুরি প্রাপ্তি বা অন্যান্য সুরক্ষা প্রাপ্তিতে নারীরা বঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতি নির্ধারণে নারীকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নারীর শ্রম, মেধা ও কষ্টসহিষ্ণুতাকে যৌক্তিক ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রহণ করা হবে। নারী শ্রমিকদের জন্য আলাদা ডেটাবেজ থাকবে।
৩০. রাষ্ট্রীয়ভাবে শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য আলাদা ডেটাবেজ তৈরি করা হবে। ডেটাবেজ অনুযায়ী, ভবিষ্যতে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে যে কোনো আপদ-বিপদে সহায়তা করা হবে।
৩১. প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৩০ লাখ নতুন শ্রমিক। কিন্তু আনুপাতিক হারে বাড়ছে না তাদের কর্মক্ষেত্র। এই শ্রমিক আধিক্যের কারণে কমমূল্যে তাদের লুফে নিচ্ছেন মালিকরা, ফলে কমে যাচ্ছে শ্রমের মূল্য। ভবিষ্যতে সম্মিলিত শ্রমিক পরিষদ (এসএসপি) ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতৃত্বে শ্রমের যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করা হবে।
৩২. শ্রমিক বাঁচলেই শিল্প বাঁচবে, কৃষি বাঁচবে। গতিশীল হবে দেশের অর্থনীতির চাকা। যার মধ্য দিয়ে বাঁচবে দেশ ও জনগণ। আজকের শ্রমিক কনভেনশনের অঙ্গীকার চলমান ১ দফার আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি শেষে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের সরকারকে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারীদের দাবি পূরণ করে মেহনতি মানুষের ভালোভাবে বাঁচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
শ্রমজীবী কনভেনশনে প্রধান অতিথি হিসেবে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া আরও উপস্থিত আছে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হকসহ অন্যান্যরা।
সভাপতিত্ব করেন শ্রমিক কর্মচারী কনভেনশন আয়োজন কমিটির সমন্বয়ক ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৩
ইএসএস/এসআইএস