ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের অপতৎপরতা এবং চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে, উগ্রবাদী জনগোষ্ঠী এবং পরাজিত অপশক্তি দেশে পুনরায় গণতন্ত্রের কবর রচনা করবে। অপরদিকে গণতান্ত্রিক বিশ্বে ইমেজ সংকটে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চরিত্র সমুন্নত রাখতে চরমপন্থা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদী অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। পাশাপাশি গণহত্যাকারী পলাতক মাফিয়া চক্রকে যেকোনো মূল্যে বিচারের সম্মুখীন করার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির আগামী দিনের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত এটাই।
বুধবার (১৯ মার্চ) রাজধানীর ইস্কাটনের লেডিস ক্লাবে বিএনপির ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের সম্মানে এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে বিএনপি। এতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, জাতীয় পার্টি (জাফর)-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের র্শীষ নেতারা অংশ নেন।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, আমাদের সকলের চিন্তা, ভাবনা হয়তো এক নয়। আমাদের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তা রয়েছে, ভিন্ন দল-মত-দর্শন রয়েছে। তবে মতে ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু সবাই একসঙ্গে বসেছি। এটাই আমাদের বাংলাদেশ। এইটি আবহমানকালের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের এক অনন্য প্রতিফলন। তবে দুঃখজনকভাবে গত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসন শোষণে দেশের শুধুমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি এসব কিছুকেই ধ্বংস করে দেয়নি, বরং বাংলাদেশের আবহমানকালের ধর্মীয় সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকেও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক সম্প্রতি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে নষ্ট করে দিয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, একটি রাষ্ট্র এবং সমাজের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক সম্প্রীতি ও মূল্যবোধ যদি বিনষ্ট করে দেওয়া যায়, তখনই সমাজ ব্যবস্থা অবক্ষয়গ্রস্ত, ভঙ্গুর, নিষ্ঠুর এবং অমানবিক হয়ে ওঠে। ভঙ্গুর রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা উগ্রবাদ আর চরমপন্থা বিকাশের এক উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়। সম্প্রতি হঠাৎ করে অতীতের মতো দেশে পুনরায়, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। নারীদের নিরাপত্তাহীন রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। সরকার, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি, কিংবা অন্য কোনো কাজে বেশি মনোযোগী থাকার কারণে আমাদের মা, বোন, কন্যাদের নিরাপত্তা সংকটে পড়েছে কি না, এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার আর জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জুলাই আগস্টে বীর জনতার রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে মাফিয়া সরকার পালিয়েছে। মাফিয়া সরকারের পতনের পর সাত মাস পার হয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশক মাফিয়া শাসন শোষণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ মেরামতের জন্য হয়তো এটা খুব বেশি সময় নয়। তবে আগামী দিনগুলোতে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম কিংবা কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা জনগণের সামনে আরও স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট হলে জনমনে থাকা সকল সন্দেহের অবসান হতো।
তারেক রহমান আরও বলেন, শুধুমাত্র একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই মাফিয়া সরকারের পতন ঘটেনি—একথা যেমন সত্য, তার চেয়েও আরও চরম সত্য হয়তো একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন না করার জন্যই মাফিয়া সরকারের নির্মম পতন হয়েছিল। সুতরাং একটি নির্বাচনকে শুধুমাত্র কোনো একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়া না যাওয়ার বিষয় হিসেবেই বিবেচনা করার অবকাশ নেই। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার সুযোগ পান। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদ এবং সরকার গঠিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। সর্বোপরি, প্রতিটি সফল ও কার্যত নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের চুক্তি, নবায়িত রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণের মালিকানা সম্পর্ক গভীরতর হয়। রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সোচ্চার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা, এমনকি দু’একটি রাজনৈতিক দলকেও জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে ইদানীং কিছুটা ভিন্ন সুরে কথা বলতে শোনা যায়। আমরা মনে করি, জনপ্রত্যাশার প্রতি শ্রদ্ধা না দেখিয়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তোর নামে গৌণ ইস্যুকে মুখ্য করে, অকারণে সময়ক্ষেপণের চেষ্টা হলে, সেটি জনমনে ভুল বার্তা পৌঁছালে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা এবং সরকারের কার্যক্রমের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট সৃষ্টি হলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠারকরণে যাত্রাপথ বিপদসংকুল হয়ে উঠতে পারে। অপরদিকে এ ধরনের পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত পলাতক মাফিয়া চক্রের দোসরদের পুনরুদ্ধারের পথকে সুগম করবে।
সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিভিন্ন খাতের সংস্কার প্রস্তাবগুলো ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে। আমি অনুরোধ করব, এগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে মতামত দিতে, যাতে সবাইকে নিয়ে সামনের পথ এগোতে পারি।
জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে এখনো ফ্যাসিবাদী শক্তি ও তার দোসররা বিভিন্ন জায়গায় রয়ে গিয়েছে। আমরা যেটা বলেছি, ফ্যাসিবাদী সিস্টেমটা পাল্টাতে হবে। বাংলাদেশের নেতৃত্ব আগামীতে যার হাতেই যাক না কেন, একটি পরিবর্তিত ব্যবস্থা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, একটি কথা বলা হচ্ছে যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, আমি মনে করি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার মতো, দেশের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার মতো রাজনৈতিক দল বা পক্ষ বাংলাদেশে রয়েছে। ৫ আগস্ট যে শক্তিকে বাংলাদেশের মানুষ পরাজিত করেছে, মুজিববাদ ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে বিতাড়িত করেছে, আগামীতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও নির্বাচনে সেই মুজিববাদী রাজনীতির কোনো স্থান হবে না।
এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, একটি বিচার প্রক্রিয়া চলমান আছে, সেই বিচারের আগে (রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ) প্রশ্নই ওঠে না। আমি রাজনৈতিক দলের প্রতি এই আহ্বানটাও রাখব, যেন এই বিষয়ে আমরা একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যে আসতে পারি। আমরা সবসময় এমন এক বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছি, যেখানে রাজনৈতিক শক্তিগুলো, তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, নীতিগত পার্থক্য, সমালোচনা থাকবে। কিন্তু সবাই একসাথে বসতে পারব, আলোচনা করতে পারব দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, আজকে বাংলাদেশ একটা পরীক্ষার মাঝে অগ্রসর হচ্ছে। ৫ আগস্টে আমরা একটি বিশাল সফলতা পেয়েছিলাম। তার মূল ছিল সকল শ্রেণির মানুষের ঐক্য। আমরা সকলে প্রতিটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একটি সুন্দর সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়ার জন্য এখনো জাতীয় ঐক্যই হবে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। এই ঐক্য রেখেই যার যার জায়গা থেকে যেটি প্রয়োজন, সেটি অবশ্যই আমরা এখানে ইমপ্লিমেন্ট করার চেষ্টা করব। জামায়াতের পক্ষ থেকে চারটি পয়েন্টে জাতীয় ঐক্যের জন্য আমি সকলের কাছে অনুরোধ জানাই। এক. বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, এখানে কোনো আপস হবে না। দুই. একটি টেকসই গণতন্ত্র। তিন. একটি ফেয়ার নির্বাচন। চার. দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় ইফতার মাহফিলে বক্তব্য দেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। ইফতার মাহফিলে দোয়া পরিচালনা করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক।
ইফতার মাহফিলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, জেএসডির সিনিয়র সহ-সভাপতি তানিয়া রব, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুব্রত চৌধুরী, ইসলামী ঐক্য জোটের চেয়ারম্যান আব্দুর রকিব, বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহদাত হোসেন সেলিম, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা, এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ড. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারী, জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টির নেতা মীর আমীর হোসেন আমুসহ বিভিন্ন দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের জোট এবং দলগুলোর নেতারাও ইফতার মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির নেতাদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা ইফতারে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সময়: ২১৫২ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
টিএ/এমজেএফ