ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাজনীতি

গণআন্দোলনে পতন হলেও ‍‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠেন এরশাদ

শামীম খান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৯
গণআন্দোলনে পতন হলেও ‍‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠেন এরশাদ ফাইল ফটো

ঢাকা: প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি পদে ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় নয় বছর সরকার চালিয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তৎকালীন এ স্বৈরশাসক গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও কিছু দিনের মধ্যেই তিনি দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। 

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- প্রধান দুই দলের কাছেই এরশাদ গুরুত্ব পেয়ে যান, কেবল ভোটের রাজনীতির কারণে। রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকেই চির বিদায় নিয়েছেন এরশাদ।

এর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটেছে দেশের রাজনীতিতে আলোচিত একটি অধ্যায়ের।

তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখলের পর সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন তিনি। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় শুরু থেকেই রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসমাজ সোচ্চার হয়ে ওঠে।  

সামরিক আইন জারি করে এরশাদ আন্দোলন দমিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও এক বছরের মাথায় দুর্বার ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮২ সালের নভেম্বরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এরশাদ সরকারের কুখ্যাত শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসমাজ স্মারকলিপি দিতে গেলে পুলিশের গুলিতে জয়নাল, দীপালি সাহাসহ ১০ জনের বেশি আন্দোলনকারী প্রাণ হারান।  

শুরু হয় সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যে আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্ত হন। আন্দোলনকে ভণ্ডুল করতে মাঝে এরশাদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন বাহানা সামনে আনলেও নব্বইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তিনটি জোট ১৫ দল, ৭ দল এবং ৫ দল যুগপৎ আন্দোলনে নামে।  

স্বৈরাচারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে ছাত্র, যুব, রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ অসংখ্য মানুষ প্রাণ দেন। অবশেষে এরশাদ ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেও ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদ জেলের মধ্যে থেকেই জাতীয় সংসদের পাঁচটি আসনে তার দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে পাঁচটিতেই জয়ী হন। ওই নির্বাচনে এরশাদের আসনসহ জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পায়।  

রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলেও কিছু এলাকায় তার দল জাতীয় পার্টির প্রভাব ছিলো লক্ষণীয়, বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলে। এর পেছনে এরশাদের প্রভাবই কাজ করেছে। আর এ কারণেই এরশাদ ক্ষমতার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। যার ফলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- উভয়ই এরশাদকে সুবিধামতো সময়ে জোটে টানার চেষ্টা করেছে।  

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দল বিএনপি এরশাদকে নিয়ে জোট গঠন করে। এ সময় জামায়াত এবং এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে চার দলীয় জোট গঠন করে বিএনপি। তবে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত এরশাদ ওই জোটে থাকেননি। নির্বাচনের আগেই সে জোট থেকে বেরিয়ে যান তিনি।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের মেরুকরণ তৈরি হয়। এই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাম-গণতান্ত্রিক দলগুলোর সমন্বয়ে ১৪ দল গঠিত হয়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ২০০৬ সালে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ।  

পল্টন ময়দানে আয়োজিত মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে এই মহাজোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ওই মহাসমাবেশের প্রধান আকর্ষণ ছিল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের উপস্থিতি।  

ওই সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সাবেক নেতা, বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এরশাদের সঙ্গে জোট করা নিয়ে ১৪ দলের শরিক বাম দলগুলো প্রথম দিকে আপত্তি করলেও পরে ওই দলগুলো মেনে নিতে বাধ্য হয়।  

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে মহাজোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পার্টি থেকে একজনকে মন্ত্রী করা হয়। তিনি ছিলেন এরশাদের ছোট ভাই (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের।
  
২০০৬ সালের পর থেকে এরশাদ মহাজোটে থাকলেও তাকে আবার জোটে নিতে চেষ্টা অব্যাহত রাখে বিএনপি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরশাদের নাটকীয় অবস্থান ছিল ওই সময়ের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ওই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে এবং জাতীয় পার্টিকেও ভোট থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে।  

সেসময় জাতীয় পার্টির নির্বাচনে অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়ে এরশাদ কয়েক দফায় অবস্থান পরিবর্তন করেন। এরশাদকে আওয়ামী লীগের জোট থেকে বের করে আনা এবং নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য বিএনপির দিক থেকেও ভেতরে ভেতরে বিভিন্ন কৌশল নেওয়া হয়।

শেষ মুহূর্তে জাতীয় পার্টির মধ্যেও দ্বিধা-বিভক্তি তৈরি হয়। এরশাদ দলের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নির্বাচন থেকে সরে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু এরশাদের স্ত্রী ও দলের সিনিয়র নেত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি বড় অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়।  

দলীয় প্রধানের নির্দেশে জাতীয় পার্টির কিছু প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও এরশাদ নিজে কিন্তু রংপুর-৩ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। সেই আসনে তিনি নির্বাচিতও হন। নির্বাচনের পর দশম সংসদে রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পান। এরশাদকে প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ দূত’ করা হয়। জাতীয় পার্টি থেকে তিনজনকে ওই সরকারের মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়।  

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসবে কি আসবে না, এমন দ্বন্দ্বে দোলাচলে পড়ে যান এরশাদও। মহাজোটগতভাবে ভোটে যাবেন নাকি আলাদাভাবে ভোটে যাবেন, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখেন।  

শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোটে যায়। একাদশ সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা মনোনয়নের ক্ষেত্রেও এরশাদের স্ত্রী রওশন ও ভাই কাদের নিয়ে তার মধ্যে দোলাচল পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু শেষে এরশাদই বিরোধী দলের নেতা মনোনীত হন।

বাংলাদেশ সময়: ১০২১ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১৯
এসকে/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।