ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

রোজায় যা যা ঘটছে আপনার শরীর ও মনে

ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা উষা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
রোজায় যা যা ঘটছে আপনার শরীর ও মনে ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা উষা

খুলনা: শুরু হয়েছে পবিত্র মাহে রমজান। সেই সঙ্গে সাহ্‌রি ও ইফতার, রোজার আগে পরে খাবারের মেন্যু ঠিক করা, সেহরিতে ওঠার জন্য এলার্ম সেট করা।

ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আমরা তো রমজানে প্রবেশ করেছি, কিন্তু রমজান আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে কি?

রোজা বলতে প্রাথমিকভাবে আমরা বুঝি  না খেয়ে থাকা। অর্থাৎ রোজার প্রথম প্রভাব ক্ষুধা। বিশেষ করে প্রাত্যহিক খাবারের সময়গুলোতে এই ক্ষুধার স্মরণ আমাদের বিচলিত করে তোলে। প্রথম ৪ ঘণ্টা রোজা শুরুর এই সময়টাতে আমরা তেমন কিছু বুঝতে পারি না। কারণ এসময় রক্তে যতটুকু গ্লুকোজ  থাকে তা অগ্নাশয় থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন ব্যবহার করে শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। ইনসুলিনের এই কর্মকাণ্ড টাইপ টু ডায়াবেটিস (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স) রোগীদের জন্য বড় উপকারী।

কিন্তু চার ঘণ্টা পর থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি যোগাতে শরীর খুঁজে বেড়ায় তার সঞ্চিত ভাণ্ডার। আর ১২ ঘণ্টার দিকে সাড়া পরে যায় শরীরের খুবই যত্ন করে রাখা জমানো শক্তি ভান্ডারে। যাকে বলা হয় চর্বি বা ফ্যাট। এই পর্যায়টি রমজানের রোজা রেখে ওজন কমানোর পর্যায়।

অনেকেই বলেন, রোজা রাখলাম, কিন্তু আমার ওজন তো কিছুই কমলো না? পক্ষান্তরে যদি ওজন বাড়ে তাহলে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। কেননা যতটুকু বাড়ছে পুরোটাই চর্বির ওজন। এ সময় পেশির ওজন খুব কম বাড়ে।

মূলত রোজা শুরুর আগে কী খাওয়া হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে চর্বি পোড়ানোর পর্যায় কখন আসবে। প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট/শর্করা (ভাত আলু খিচুড়ি বিরানি) খাবার খেলে এ পর্যায় দেরিতে শুরু হয়। অন্যদিকে চর্বি বা প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে এই পর্যায়টি তুলনামূলক দ্রুত আসে। অর্থাৎ আপনার খাবার মেন্যুর ওপর নির্ভর করবে রোজায় আপনার শরীর আপনাকে কতটুকু ওজন কমিয়ে দেবে।

শুধু না খেয়ে থাকাই সব নয়। এই ধাপের শেষে সাধারণত চর্বি ভেঙে এসিড উৎপন্ন হয়। সেখান থেকে তাপ। সেটা ত্বরান্বিত করে শরীরের বিপাক ক্রিয়া, এতে হজম শক্তি বেড়ে যায়। কিন্তু অনেকেই এসিডিটির কমপ্লেন করেন। এর পাশপাশি সাহ্‌রি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়া, অতিরিক্ত মসলাদার খাবারও ‌জড়িত।

১৬ ঘণ্টার দিকে শুরু হয় অটোফেজি প্রক্রিয়া। রোজার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যে সময়টিকে আমরা বলি ‘রোজা লেগে গেছে’ বা ‘রোজায় ধরেছে’। অটোফেজি প্রক্রিয়ায় শরীর তার বিপাকক্রিয়ায় ফলে উৎপন্ন সেই সব ক্ষতিকর এবং মৃত বর্জ্যকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়, যেগুলো আমাদের স্মৃতিক্ষয়, বার্ধক্য, ক্যান্সার, পাথর অনেক দীর্ঘ মেয়াদী রোগের কারণ। আর এসব সুস্থতার প্রক্রিয়াগুলো আসলে দীর্ঘ সময় পাকস্থলী খালি থাকাতেই ঘটছে, এমনটাই জানিয়েছে মাইন্ডবডিগ্রিন ডটকম ওয়েবসাইট।

পুরো একমাস রোজা রাখায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো দৈনিক ৫-৬ ঘন্টা বিশ্রামের সুযোগ পায়। দেহের পুরনো ক্ষতিগ্রস্ত শ্বেত রক্তকণিকা রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে আবার জেগে ওঠে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আগের তুলনায় বহুগুণ বাড়ে।

শারীরিক এত এত উপকারের পাশাপাশি মানসিক অবসাদ দূর করে মনকে সচল রাখাও রোজার অন্যতম গুণাবলী। দেখবেন রোজার শেষ সময়ে অন্য কারণে আপনার ভীষণ রাগ হলেও আপনি রাগ করতে পারছেন না। কারণ একে তো শরীরের জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে, অন্যদিকে মানসিকভাবে আপনি রাগ না করে শক্তি রিজার্ভ করে রাখার কথা ভাবছেন। ‘আজ রোজা, আজ মিথ্যা বলা যাবে না’ ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে আপনিও হয়তো এই বুলি আওড়েছেন।

যে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য এই পৃথিবীতে আসা, সেই খাবার লোভকে নিয়ন্ত্রণ করে, শরীর ও মনকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার মাধ্যমে রোজা আমাদেরকে প্রকৃতির বিস্ময়কর হিলিং পাওয়ারের সঙ্গে আমাদের মেলবন্ধন করিয়ে দেয়। চন্দ্রমাসের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রমজানের এই আবর্তন প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের এই মেলবন্ধনকে আরও গাঢ় করছে। তাই কোনো রমজানে আমাদের লেপ থেকে উঠতে কষ্ট হয়, কোনো রমজানে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা।

যেহেতু খাবারদাবারের ঊর্ধ্বে গিয়ে এক বিরাট মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রমজান আমাদের জীবনে আসে, তাই কোনভাবেই অতিরিক্ত ও মসলাদার খাবার খেয়ে, পানি, ফল, শরবত কম খেয়ে আপনার সুস্থতার দরজা বন্ধ করবেন না। যতটা সবুজ খাবারের সঙ্গে থাকবেন ততই মঙ্গল। আঁশ জাতীয় খাবার আপনাকে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেবে। দুধ, টক দই, খেজুর পুরোটা দিন এনার্জি দেবে। গভীর রাতে উঠতে পারেন না দেখে সারারাত জেগে সাহ্‌রি করে ঘুমাবেন না। তারাবির নামাজে মাত্র ২০০ ক্যালরি শক্তি খরচ হয়। খাবারের পর এই একটু ব্যায়াম কী যে উপকারী!

খাবার নিয়ন্ত্রণ, হালকা ব্যায়াম, মানসিক সংযম মাত্র এক মাসেই সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ হয়ে ওঠার সুযোগ আপনার সামনে...।

প্রতিদিন ছোট্ট করে একটা ভালো কাজ হোক। হোক সেটা আপনার রিকশাওয়ালাকে নিয়ে ইফতার করা, ইফতার পার্টিতে দাওয়াত খেতে গিয়ে খাবার নষ্ট না করা, আপনার কাছের বন্ধু যে কখনো মুখ ফুটে তার পরিবারের সমস্যার কথা বলে না তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলা, কী হয়েছে জানতে চাওয়া…। করা তো পরের কথা। শুধু ভাবুন আগে…। মন থেকে কেমন একটা সুখ সুখ লাগছে না! হয়তো আমাদের এই সুখ দিতেই রমজান আসে…। আমাদের শুধু সুখগুলো কুড়োনোর পালা…।

রমজান আমাদের জীবনে প্রবেশ করুক গভীর থেকে গভীরতর হৃদয় উপলব্ধি হয়ে। খোশ আমদেদ মাহে রমজান।

ডা. শেখ সাদিয়া মনোয়ারা উষা, মেডিকেল অফিসার (সিএস),খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০২৩
এমআরএম/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।