সমাজে এখন আধ্যাত্মিক অনুরাগ ও ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশ প্রতীয়মান। অমুসলিমরাও মর্ত্যের সব প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যর্থ হয়ে শেষ আশা হিসেবে হাত তুলেছে আকাশ পানে।
পবিত্র রমজান মাস উপনীত হলেই মদিনার পরিবেশ-পরিস্থিতি বদলে যেত, যেভাবে এখন বদলে গেছে আমাদের আজকের পৃথিবী। রমজান এলেই রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের এবং সাহাবিরা একে অপরকে রমজানের আগমনী বার্তা দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতেন। স্মরণ করিয়ে দিতেন এই মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য। এতে স্বাভাবিক কার্যক্রম থেমে যেত। প্রত্যেকেই মনোনিবেশ করতেন নিজ নিজ আমলের উন্নতির দিকে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মাহে রমজান এলেই রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বলতেন, তোমাদের কাছে রমজান উপনীত হয়েছে, মহিমান্বিত ও বরকতময় মাস। যে মাসে তোমাদের ওপর আল্লাহ সিয়ামকে ফরজ করেছেন। এ মাসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের ফটকগুলো বন্ধ করা হয়, বিতাড়িত শয়তানগুলোকে বন্দি করা হয়। এ মাসে এমন এক রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম, যে এই মাসের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে যেন সব হারাল। (নাসাঈ : ৪/১২৯)
আগের মুসলিম মনীষীদের অবস্থাও ছিল এমন। রমজান এলেই সবাই পাঠদান স্থগিত করে ইবাদতে বেশি আত্মনিয়োগ করতেন। রমজান এলেই ইমাম জুহুরি (রহ.) অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে বলতেন, এ হচ্ছে কোরআন তিলাওয়াত ও অন্যকে আপ্যায়নের মাস। (তামহিদ : ৬/১১১)। ইবনুল হাকাম বলেন, রমজান এলে ইমাম মালেক (রহ.) হাদিসের পাঠাগার ও ইলমের মজলিসগুলো স্থগিত করে দিতেন। (লাতাইফুল মাআরিফ : ১/১৮৩)
এখন বিশ্বজুড়ে প্রায় সব পাঠ ও শিক্ষা প্রদান বন্ধ আছে। এই অবসর আমাদের ইবাদতে মশগুল হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে।
যে পরিবর্তনটি এবার খুব বেশি আমাদের নজরে আসবে, তা হলো খাদ্যাভ্যাসে সংযম ও মিতব্যয়িতা। যা আমাদের নবীযুগের রমজানগুলোর স্বাদ ও তৃপ্তি দিতে যাচ্ছে। ইফতার ও সাহরিতে আগের মতো এবার আর সেই অপচয়সর্বস্ব জৌলুস থাকবে না। অনাড়ম্বর আয়োজনে সাহরি ও ইফতার সম্পন্ন হবে, যা আমাদের জীবনে সাহাবিদের আদর্শ অনুকরণের ইচ্ছা সৃষ্টি করতে যথেষ্ট। এবং বছরের বাকি মাসগুলোতেও এর রেশ ধরে রাখার আগ্রহ তৈরি করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিরা খেজুর দিয়ে সাহরি করতে পছন্দ করতেন, আর খেজুর বা পানি দিয়ে ইফতার করতেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৩৪৫, তিরমিজি, হাদিস : ৬৯৬)
প্রযুক্তির ব্যস্ততা আগে আমাদের জীবনের যে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কেড়ে নিত, তা হয়তো আবার ফিরে আসবে। ইবাদতের জন্য বরাদ্দ হবে বেশ কিছু বাড়তি সময়। তিলাওয়াত, জিকির ও আমলে নতুন করে তৃপ্তি পাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। বন্ধ হয়ে আছে বহির্জীবনের নানা মন্দ জায়গা। সিনেমা হল, বাজার, রেস্তোরাঁসহ ইত্যাদি পাপ-প্রতুল স্থানগুলো এখন নিষিদ্ধ ভূমি। মনে হচ্ছে রমজানের সেই বিখ্যাত হাদিসটির দৃশ্যমান কিছু প্রভাব সত্যিই এবার দৃষ্টিগোচর হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যখন রমজানের প্রথম রাত আগমন করে, তখন শয়তান ও বিতাড়িত জিনদের শিকলবদ্ধ করা হয়। (তিরিমিজি, হাদিস : ৬৮২, ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬৪২)
করোনাকালীন এই রমজান আমাদের জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত নিয়ে এসেছে। আমাদের আকিদা-বিশ্বাসকে দৃঢ় করার মতো যথেষ্ট ঘটনা ঘটছে। আল্লাহর হিকমতপূর্ণ কুদরতি চিহ্ন এখন বিশ্বময়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভার্চুয়াল ক্ষমতা এই বিপর্যয়ের সামনে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছে। রমজান আমাদের আকিদা মেরামতের মৌসুম। লাইলাতুল কদরের গভীর দীক্ষা যেন আমাদের বিশ্বাসকে আবারও শাণিত করে। তাকদিরের ওপর আমরা অগাধ বিশ্বাস রাখব। আল্লাহর প্রতি সুধারণা রাখব যে অতি শিগগির তিনি এই বিপদ থেকে আমাদের মুক্তি দান করবেন। অনেকেই যেভাবে বলছেন ‘কোয়ারেন্টিন’কে কোরআনটাইম বানানোর জন্য—তা যেন মুখের কথাতেই আটকে না থাকে। এবারের রমজানটা সত্যিকার অর্থেই যেন কোরআনের মাস হয়ে ওঠে—তার পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। মসজিদ বন্ধ হয়েছে, ওমরাহ বন্ধ হয়েছে। কোরআন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই যেন আমরা এর মাহাত্ম্য অর্জন করে নিতে পারি। যিনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস দিয়ে মসজিদের নিয়ামত স্থগিত করতে পারেন, তিনি অসন্তুষ্ট হলে অণুমাত্র কারণ দিয়েও কোরআন থেকে আমাদের বঞ্চিত করার ক্ষমতা রাখেন।
হাদিসে ইঙ্গিত আছে, রমজানের মধ্যেই যেকোনো মহামারি হ্রাস পায়। আমাদের দোয়া থাকবে, আল্লাহ যেন বিশ্ববাসীকে এই করোনা থেকে পরিত্রাণ দেন এবং এই পরীক্ষায় আমাদের সবর দান করেন। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। তিনি চাইলে এক নিমেষেই স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে পারেন। ইনশাআল্লাহ, ঈদের নামাজ আমরা ঈদগাহে আদায় করতে পারব।
আল-কাসিম বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব থেকে
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২০