সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাগবাটি ইউনিয়নের পিপুলবাড়িয়া গ্রামে দর্জির কাজ করেই সংসার চালাতেন এস এম শামীম রেজা।
কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি তানভীর শাকিল জয় ও উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে সখ্য থাকায় বদলে যায় তার ভাগ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এস এম শামীম রেজা ২০১২ সালেও পিপুলবাড়িয়া বাজারে দর্জির কাজ করতেন। এরপর একটি এনজিওতে চাকরি নেন। তিন বছর এনজিওতে চাকরি করার পর ২০১৫ সালে শান্তা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নেন। তার দুঃসম্পর্কের মামা কাজিপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান সিরাজী। সেই সম্পর্কই হয় তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি। তার প্রভাব খাটিয়ে নীতিমালা বহির্ভূতভাবে কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র মেরামত, স্লিপ, রুটিন মেরামত, প্লেইং এক্সেসরিজের কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। এসব প্রকল্পের কাজে ব্যাপক নয়-ছয় করে বিপুল অর্থের মালিক বনে যান।
তার বিরুদ্ধে দফায় দফায় নিম্নমানের কাজ করার অভিযোগ উঠলেও কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে সেই সময়ের এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রভাব খাটিয়ে জোর করে বিল তুলে নিতেন। আর এভাবেই অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জন করে চারতলা বাড়ি বানিয়েছেন।
বর্তমানে পিপুলবাড়িয়া বাজারে তার তিনটি জমি রয়েছে। যার মোট পরিমাণ ১৬ শতক। দুটি জমির ওপর বাড়ি করেছেন। সব মিলিয়ে ওই সম্পদের মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। সীমান্ত বাজার এলাকায় পাঁচ শতক জমির ওপর বিলাসবহুল চারতলা ভবন যার মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা, এছাড়া ভেন্নাবাড়ি সাত শতক জমি বাউন্ডারি করা। সম্প্রতি ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনার চিন্তাও করছেন বলে স্থানীয় বেশকিছু সূত্র জানিয়েছে।
কাজিপুর উপজেলার আলমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আফানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গান্ধাইল উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বয়ড়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টেংলাহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জানান, শান্তা এন্টারপ্রাইজ দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জোর করেই ক্ষুদ্র মেরামত, স্লিপ, রুটিন মেরামত, প্লেইং এক্সেসরিজের কাজ বাগিয়ে নিত। নিম্নমানের কাজ করে প্রকল্পের টাকা নয়-ছয় করেছে। এরই মধ্যে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই তার সরবরাহ করা মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে।
হারুন-অর-রশিদ নামে এক শিক্ষক বলেন, ২০২১-২২ অর্থ বছরে বয়রাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ মেরামত করে শান্তা এন্টারপ্রাইজ। তিন বছরের মধ্যে ওই কক্ষের সবগুলো দেয়াল ফেটে গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ওই কক্ষটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
আলমপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান বলেন, শান্তা এন্টারপ্রাইজ আমাদের প্রতিষ্ঠানে খেলনা সামগ্রী সরবরাহ করেছিল। যেটা এত নিম্নমানের ছিল যে পাঁচ মাসও ব্যবহার করতে পারেনি শিশুরা।
আব্দুল আলীম নামে এক সহকারী শিক্ষক বলেন, গান্ধাইল উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দোলনা সরবরাহ করেছিল শান্তা এন্টারপ্রাইজ। সবগুলো দোলনা নষ্ট হয়ে গেছে।
শিক্ষকরা আরও বলেন, এভাবেই প্রকল্পের কাজে অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাট করেছেন শামীম রেজা। সামান্য দর্জি থেকে হয়েছেন কোটিপতি।
এদিকে চলতি বছর নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিকেই প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন শামীম। তিনি তদবিরে ব্যর্থ হয়ে শিক্ষা অফিসারকেই ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এস এম শামীম রেজা আগে দর্জির কাজ করার কথা স্বীকার করে বলেন, আমি অনেক পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করেছি। কোনো অবৈধ কাজ করিনি।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপির সুপারিশে শিক্ষা অফিসের কাজ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান খলিল সিরাজী আমাদের এলাকায় বিয়ে করেছেন, সেই সুবাদে তাকে আমি মামা বলি। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান বিল উঠানোর জন্য মাঝে মধ্যে তার কাছে যাওয়া হয়েছে।
কাজিপুর উপজেলার সহকারী শিক্ষা অফিসার আবু সাঈদ বলেন, বিভিন্ন কাজ বিধি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এসএমসির বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও বিগত সরকারের আমলে এখানে ব্যতিক্রম হয়েছে। সাবেক এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রভাব খাটিয়ে শান্তা এন্টারপ্রাইজ এসব কাজ করেছে। কাজগুলো বেশিরভাগই ছিল নিম্নমানের। এবার নীতিমালা মোতাবেক ম্যানেজিং কমিটিকেই কাজ দেওয়া হবে।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার হাবিবুর রহমান বলেন, এ বছর আমরা বিধিমালা অনুযায়ী এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। শান্তা এন্টারপ্রাইজের আগের কাজগুলোর মান ছিল অত্যন্ত খারাপ।
এ বিষয়ে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান সিরাজী ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) তানভীর শাকিল জয় পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এসআই