যশোর: ৫ আগস্ট দুপুর দুটোর দিকে মোবাইল ফোনে ঢাকা থেকে বাবা আব্দুল জব্বারকে ফোন করেছিলেন মো. আব্দুল্লাহ। বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে আব্বা’।
আব্দুল্লাহ ছিলেন ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বাড়ি যশোরের বেনাপোলের বড়আঁচড়ায়। বাবা আব্দুল জব্বার, মা মারিয়া খাতুন। বড় দুই ভাই হ্যান্ডলিং শ্রমিক। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
বেনাপোল পৌরসভার বড়আঁচড়া বায়তুল মামুর জামে মসজিদ চত্বরের কবরস্থানে বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) দুপুরে যেয়ে দেখা যায় শহীদ আব্দুল্লার কবর সংস্কারের কাজ করছেন শ্রমিক আব্দুল হাই। তিনি জানান, ঢাকা থেকে নির্দেশ এসেছে সকল জুলাই শহীদের কবরের ওপরের ওয়াল একই নকশার হতে হবে। সেই নকশাও চলে এসেছে। তাই আগের প্রাচির ভাঙা হচ্ছে।
সেসময় জোহরের নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদের ভেতরে অবস্থান করছিলেন শহীদের বাবা আব্দুল জব্বার। সাংবাদিক এসেছেন শুনে তিনি বাইরে বের হন। ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে (আব্দুল্লাহ) বলতো শিক্ষিত হয়ে যদি চাকরি না পাই তাহলে সেই জীবন থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো’। সে কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে প্রথম থেকেই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন আব্দুল্লাহ। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারের দমন-পীড়ন আর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলেও রাজপথ ছাড়েননি তিনি।
বাবা বলেন, ‘৫ আগস্ট জোহরের নামাজের পর আব্দুল্লাহ আমাকে মোবাইলে ফোন দিয়ে বলে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে আব্বা’। আমি বললাম-কই, আমরাতো শুনিনি। দেখি টেলিভিশনে কিছু বলে কিনা। সেটিই ছিল আব্দুল্লাহর সঙ্গে বাবার শেষ কথা।
এদিন রাত সাড়ে দশটার দিকে জামাতা আব্দুল জব্বারকে ফোন করে আব্দুল্লাহর গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানান। তারা স্বামী-স্ত্রী একটি প্রাইভেট কার নিয়ে রাত দুটোর দিকে রওনা দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছান পরের দিন ৬ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে।
এসময় আব্দুল্লাহকে অপারেশন কক্ষ থেকে বের করে বেডে নেওয়া হচ্ছিল। ঢাকা মেডিকেলে ১৭ দিন চিকিৎসা চলার পর নৌবাহিনীর সদস্যরা এসে তাকে ঢাকা সিএমএইচ এ নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসা চলাকালীন মোট একশ’ দিনের মাথায় ১৪ নভেম্বর মৃত্যুর কাছে হার মানেন জুলাই যোদ্ধা আব্দুল্লাহ।
ময়নাতদন্ত এবং অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে পরেরদিন ১৫ নভেম্বর মরদেহ বাড়িতে পৌঁছে। এদিন রাতেই তাকে দাফন করা হয় নানা-নানির কবরের পাশে।
আব্দুল জব্বার বলেন, ‘ছেলের আমার ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করে একটা ভালো চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু, দেশের স্বার্থে সে রাস্তায় নেমে আসে। সে জীবন দিয়েছে দেশের জন্য, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য’।
নিজের ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন জানিয়ে শহিদ আব্দুল্লাহর বাবা আব্দুল জব্বার বলেন, আমি শুধু নিজের ছেলে হত্যার বিচার চাই না। বিচার করতে হবে জুলাই অভ্যুত্থানের সকল হত্যার। ’
বর্তমানে দেশের পরিস্থিতির জন্য পতিত ফ্যাসিবাদীরাই জড়িত বলে মনে করেন এই শহীদের বাবা। তিনি বলেন, দেশতো ভালোই চলছে। যা হচ্ছে বা ঘটছে তা করছে হাসিনার লোকেরা। তবে, তিনি চাঁদাবাজি, দুর্নীতি বন্ধের আহ্বান রাখার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকারও আহ্বান জানান।
মা মারিয়া খাতুন বলেন, ‘গুলি খাওয়ার একদিন পর থেকে মারা যাওয়া পর্যন্ত আমি আর ওর আব্বা আব্দুল্লাহর পাশেই ছিলাম। অনেক কষ্ট পেয়েছে আমার ছেলেটা’।
তিনি বলেন, ‘একদিন আমার ছেলে পরোটা খেতে চেয়েছিল। ওর আব্বা পরোটা আনতে যাওয়ার পর দেখি ছেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি বললাম, আব্বা কিছু বলবা আমারে। সে বললো, আম্মু তুমি আমার পাশে থেকো। তোমাকে দেওয়ার কিছু নেই আমার। ’
এই ঘটনার তিনদিন পর আব্দুল্লাহ হাঁচি আসে। তারপর থেকেই সে নির্বাক হয়ে যায়। এভাবে ২৫ দিন চলার পর মারা যায় ছেলে-বলেন মা।
আক্ষেপ করে মা মারিয়া বলেন, ‘সেবার কোরবানির ঈদের তিনদিন পর ছেলে হঠাৎ ঢাকায় চলে গেলো। এই তিনদিন সে মামাদের বাড়িতে খেয়ে বেড়িয়েছে। বাড়ির কোরবানির মাংস না খেয়েই আমার ছেলে চলে গেলো। বলেছিল সে সামনের মাসে আসবে, তখন খাবে। ছেলে আসলো, তবে লাশ হয়ে’।
মা জানান, শেষবার যাওয়ার সময় আব্দুল্লাহকে এগিয়ে দিতে তিনি রাস্তা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। সেখানে লাইট পোস্টের নিচে মায়ের কাঁধে অনেকক্ষণ মাথা রেখে নানা কথা বলেছিলেন আব্দুল্লাহ। সে বলেছিল, মা আর কিছুদিন অপেক্ষ করো, আমাদের সুদিন আসবে।
তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে আব্দুল্লাহ ছিলেন সবার ছোট। তার জন্ম ২০০১ সালের ২৮ এপ্রিল। বড়ভাই জাহাঙ্গীর আলম ও মেঝোভাই নুর আলম মিঠু গোডাউনের হ্যান্ডলিং শ্রমিক। বোন মিতা খাতুন থাকেন স্বামীর কর্মস্থলে। একই বাড়িতে থাকলেও দুই ভাই নিজ নিজ পরিবার নিয়ে পৃথক থাকেন। মাকে নিয়ে আব্দুল্লাহর বাবারও আলাদা সংসার। তবে, বাবা কোনো উপার্জনে যুক্ত নেই।
আব্দুল জব্বার জানান, আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকার কারণে তারা কোনো সন্তানকে বেশিদূর পড়াতে পারেননি। তবে, ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ মেধাবী হওয়ায় শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তাকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়াচ্ছিলেন।
আব্দুল্লাহর পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাবা আব্দুল জব্বার ছিলেন বেনাপোল হ্যান্ডলিং শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। ১৬ বছর আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জোর করে তাকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বড় দুই ভাইকেও।
বাবা অনেকদিন বেকার জীবন যাপন করার পর একটি পরিবহনের কাউন্টারে টিকিট বিক্রির চাকরি নেন। ভাইয়েরা বদলি চালক হিসেবে পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে বেনাপোল দিয়ে ওপারে ভারতের হরিদাসপুরে যেয়ে খালাস শেষে ট্রাক নিয়ে ফিরে আসতেন। ফ্যাসিবাদের পতনের পর দুই ভাই আবার হ্যান্ডলিং শ্রমিকের কাজ পেয়েছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, আব্দুল্লাহ মারা যাওয়ার পর নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা, সরকারের জুলাই ফান্ড থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। এছাড়া, উপদেষ্টা হাসান আরিফ এক লাখ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন।
যশোর জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া এক লাখ টাকা পেয়েছিলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হাত থেকে। জামায়াতে ইসলামীর আমির ডাক্তার শফিকুর রহমান বাড়িতে এসে দিয়েগিয়েছিলেন দেড় লাখ টাকা। এছাড়া, আব্দুল্লাহ চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা (বর্তমানে এনসিপি নেতা) সারজিস আলম ৫০ হাজার টাকা করে দুইবার এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এর বাইরেও অনেকে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকাও দিয়েছেন।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তাদের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। ১৬ জুলাই আব্দুল্লাহর কলেজে তাঁকে নিয়ে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলন। ওইদিন যশোর জেলা প্রশাসনের অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন আব্দুল্লাহর মা ও ভাই।
নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই জানিয়ে আব্দুল জব্বার বলেন, যে বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমার ছেলেসহ হাজারো ছেলে জীবন দিয়েছে সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে না। এটা কিন্তু সহজ না। হাসিনা ও তার লোকজন নানাভাবে দেশে বিশৃঙ্খলা চালানোর চেষ্টা করবে। সে কারণে সব দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ না থাকলে হবে না।
যত দ্রুত সম্ভব হাসিনাসহ সকল খুনির বিচার দাবি করে তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ হত্যার বিষয়ে চলতি বছরের ১ জুন ঢাকা কোতোয়ালি থানায় তিনি একটা মামলাও দায়ের করেছেন।
এসএইচ