যেসব বিষয় রোজা ভঙ্গের কারণ নয়
০১. অনিচ্ছাকৃত গলার ভেতর ধুলোবালি, ধোঁয়া অথবা মশা-মাছি প্রবেশ করা।
০২. অনিচ্ছাকৃত কানে পানি প্রবেশ করা।
০৩. অনিচ্ছাকৃত বমি আসা অথবা ইচ্ছাকৃত অল্প পরিমাণ বমি করা (মুখ ভরে নয়)।
০৪. বমি আসার পর নিজে নিজেই ফিরে যাওয়া।
০৫. চোখে ওষুধ বা সুরমা ব্যবহার করা।
০৬. ইনজেকশন নেওয়া।
০৭. ভুলক্রমে পানাহার করা।
০৮. সুগন্ধি ব্যবহার করা বা অন্য কিছুর ঘ্রাণ নেওয়া।
০৯. নিজ মুখের থুথু, কফ ইত্যাদি গলাধঃকরণ করা।
১০. শরীর ও মাথায় তেল ব্যবহার করা।
১১. ঠাণ্ডার জন্য গোসল করা।
১২. মিসওয়াক করা। যদিও মিসওয়াক করার দরুন দাঁত থেকে রক্ত বের হয়। তবে শর্ত হলো গলার ভেতর না পৌঁছানো।
১৩. ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হলে।
১৪. স্ত্রীলোকের দিকে তাকানোর কারণে কোনো কসরত ছাড়া বীর্যপাত হলে।
১৫. স্ত্রীকে চুম্বন করলে, যদি বীর্যপাত না হয় (রোজা না ভাঙলেও এটা রোজার উদ্দেশ্যের পরিপন্থি)।
১৬. দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা গোশত খেয়ে ফেললে (যদি পরিমাণে কম হয়), পরিমাণ বেশি হলে রোজা ভেঙে যাবে।
এবার কোরআন-হাদিসের আলোকে বিষয়গুলো অনুধাবনের চেষ্টা করা যাক। মনে রাখা দরকার যে, রোজা ভঙ্গ হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে-
১. রোজা ভঙ্গের কারণ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা
যদি না জেনে রোজা ভঙ্গকারী রোজা ভেঙে যায় এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে না। কারণ আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারায় বলেন-
‘হে আমাদের রব! আপনি আমাদের পাকড়াও করবেন না, যদি আমরা ভুলে যাই কিংবা কোনো ভুল করে বসি। ’ -সূরা বাকারা : ২৮৬
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা ভুলে যা কর, তাতে কোনো অপরাধ নেই। অবশ্য ইচ্ছাপূর্বক তোমাদের হৃদয় যা করছে তার ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু। ’ -সূরা আহজাব : ৫
না জানার কারণে রোজা না ভাঙার বিষয়টি ব্যাপক, হতে পারে সে শরিয়তের হুকুম সম্পর্কে অজ্ঞ। যেমন, সে ধারণা করে যে এ জিনিসটায় রোজা ভাঙ্গবে না, ফলে তা করে বসে। অথবা কাজ করা অবস্থায় বা সময়ে সেটি তার অজানা ছিল। যেমন, সে ধারণা করে যে, ফজর বা সুবহে সাদিক এখনো হয়নি, ফলে সে পানাহার চালিয়ে যায় অথচ ফজরের সময় হয়ে গেছে। কিংবা সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে মনে করে খেয়ে ফেলল অথচ সূর্য তখনও অস্ত যায়নি। এসব কারণে রোজা ভঙ্গ হবে না। কারণ সহিহ বোখারিতে হজরত আসমা বিনতে আবি বকর (রা.)-এর হাদিসে এসেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা নবী করিম (সা.)-এর যুগে ইফতার করেছিলাম এক মেঘলা দিনে তারপর সূর্য দেখা গিয়েছিল। ’
এখানে তিনি উল্লেখ করেননি যে, নবী (সা.) তাদের রোজাটি কাজা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন; কারণ তাদের সময় অজানা ছিল।
২. রোজার কথা স্মরণ না থাকা
যদি রোজা পালনকারী নিজ রোজার কথা ভুলে রোজা ভেঙে যায় এমন কোনো কাজ করে ফেলেন তাহলে তার রোজা শুদ্ধ হবে, তাকে আর সেটা কাজা করতে হবে না। তাছাড়া হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে রোজা পালনকারী ভুলে পানাহার করলো, সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে; কেননা আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন। ’
নবী (সা.) কর্তৃক রোজা পরিপূর্ণ করার নির্দেশ প্রদান সে রোজা সহিহ হওয়ার স্পষ্ট দলিল। কিন্তু যখনই স্মরণ হবে কিংবা কেউ স্মরণ করিয়ে দেবে তখনই: সেটা থেকে বিরত থাকবে এবং মুখে কিছু থাকলে তাও নিক্ষেপ করবে; কারণ এখন তার ওযর দূরীভূত হয়েছে।
৩. স্বতঃস্ফূর্তভাবে রোজা ভঙ্গ করা
রোজা ভঙ্গকারী নিজের পছন্দ ও ইচ্ছা অনুযায়ী যদি রোজা ভেঙে যায় এমন কিছু করে তবেই কেবল তার রোজা নষ্ট হবে। অন্যথায় যদি রোজা পালনকারীকে জোর-জবরদস্তি করে রোজা ভঙ্গ করানো হয় তবে তার রোজা বিশুদ্ধ হবে, তার আর সেটা কাজা করতে হবে না। কারণ, আল্লাহতায়লা কুফুরির হুকুমকে সে ব্যক্তি থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন যাকে কুফুরি করতে জোর করে বাধ্য করা হয়েছে, যখন তার অন্তর ঈমানের ওপর অটল থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেউ তার ঈমান আনার পর আল্লাহর সঙ্গে কুফরি করলে এবং কুফরির জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তার জন্য রয়েছে মহাশাস্তি; তবে তার জন্য নয়, যাকে কুফরির জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচলিত। ’ -সূরা আন নাহল : ১০৬
অনুরূপভাবে রাসূল সা. বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ আমার উম্মতের ভুল, বিস্মৃতি এবং বাধ্য হয়ে করা বিষয় ক্ষমা করেছেন। ’
মাসয়ালা : যদি কোনো লোক তার স্ত্রীকে সহবাস করতে বাধ্য করে অথচ সে রোজা পালনকারিনী, তাহলে মহিলার রোজা শুদ্ধ হবে। তাকে সেটার কোনো কাজা করতে হবে না। যদিও লোকটির জন্য বৈধ নয় স্ত্রীকে রোজা অবস্থায় সহবাসে বাধ্য করা। হ্যাঁ, যদি কোনো মহিলা তার স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত নফল রোজা পালন করে সেটা ভিন্ন কথা।
মাসয়ালা : চোখে ওষুধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। হজরত আনাস (রা.) রোজা অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন। -আবু দাউদ ১/৩২৩
মাসয়ালা : রাত্রে স্ত্রী সহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের আগে গোসল করতে না পারলেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে কোনো ওযর ছাড়া, বিশেষত রোজার হালতে দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা অনুচিত।
মাসয়লা : বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। এতে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তরুণদের যেহেতু এ আশঙ্কা থাকে তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, আমরা নবী করিম (সা.)-এর নিকটে ছিলাম। ইতোমধ্যে একজন যুবক এলো এবং প্রশ্ন করলো, আল্লাহর রাসূল! আমি কি রোজা অবস্থায় চুম্বন করতে পারি? নবী (সা.) বললেন, না। এরপর এক বৃদ্ধ এলো এবং একই প্রশ্ন করলো। নবী (সা.) বললেন, হ্যাঁ। আমরা তখন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। নবী (সা.) বললেন, আমি জানি, তোমরা কেন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছো। শোনো, বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। -মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০
মাসয়ালা : অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (এমনকি মুখ ভরে হলেও) রোজা ভাঙবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোজা ভাঙবে না। বলা হয়েছে, অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তির বমি হলে তার রোজা কাজা করতে হবে না। -জামে তিরমিজি: ১/১৫৩, হাদিস : ৭২০
মাসয়ালা : শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোজা ভাঙবে না। হজরত কাতাদা (রা.) বলেন, ‘রোজাদারের তেল ব্যবহার করা উচিত, যাতে রোজার কারণে সৃষ্ট ফ্যাকাশে বর্ণ দূর হয়ে যায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক: ৪/৩১৩
মাসয়ালা : শুধু যৌন চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে রোজা ভাঙবে না। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সব ধরনের কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহ আর রোজার হালতে তো তা আরও বড় অপরাধ। কামভাবের সঙ্গে কোনো মহিলার দিকে তাকানোর ফলে কোনো ক্রিয়া-কর্ম ছাড়াই বীর্যপাত হলে রোজা ভাঙবে না। তবে রোজা অবস্থায় স্ত্রীর দিকেও এমন দৃষ্টি দেওয়া অনুচিত। এতে রোজাদার রোজার ফজিলত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। হজরত জাবের ইবনে যায়েদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীর দিকে কামভাবের সঙ্গে তাকিয়েছে। ফলে তার বীর্যপাত ঘটেছে তার রোজা কি ভেঙে গেছে? তিনি বললেন, ‘না। সে রোজা পূর্ণ করবে। ’ –সহিহ বোখারি : ১/২৫৮
মাসয়ালা : স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙ্গে না। -সুনানে কুবরা বায়হাকি: ৪/২৬৪
মাসয়ালা : চোখের দু’এক ফোটা পানি মুখে চলে গেলে রোজার ক্ষতি হয় না। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রোজা অবস্থায় সিরকা অথবা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করলে যদি তা গলার ভেতর না যায় তাহলে রোজা ভাঙে না। ’ -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/২০২
মাসয়ালা : সুস্থ অবস্থায় রোজার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায় তাহলে রোজা নষ্ট হবে না। হজরত নাফে (রহ.) বলেন, হজরত ইবনে ওমর (রা.) নফল রোজা অবস্থায় বেহুশ হয়ে যেতেন কিন্তু এ কারণে রোজা ভেঙে ফেলতেন না। -সুনানে কুবরা বায়হাকি: ৪/২৩৫
মাসয়ালা : কোনো ধরনের ইঞ্জেকশন-ইনসুলিন বা টিকা নিলে রোজা ভঙ্গ হয় না, এমনকি গ্লুকোজ ইঞ্জেকশানের দ্বারাও রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। -ফাতাওয়া উসমানি : ২/১৮৬
বাংলাদেশ সময়: ১০০৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৯, ২০২০