বিকেএসপি খেকে ফিরে: তিন মাস পর অবসরে যাবেন বিকেএসপির প্রধান ফুটবল কোচ আমিনুল ইসলাম। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইতি টানবেন দীর্ঘ ১৭ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারের।
১৯৯৯ সালে বিকেএসপিতে ফুটবল কোচ হিসেবে যোগ দান করেন আমিনুল ইসলাম। শুরুতে সহকারী হিসেবে যোগ দিলেও সময়ের পরিক্রমায় হয়েছেন প্রধান কোচ। নিষ্ঠা, সততা ও কঠোর পরিশ্রম করে শিক্ষা দিয়েছেন শিষ্যদের। তার কাছেই শিক্ষা নিয়ে আজ দেশ-বিদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মামুনুল ইসলাম, হেমন্ত, আমিনুল ইসলাম সবুজ, তৌহিদুল ইসলাম, মিসবাহ উল মানিক ও মাকসুদুর রহমানের মতো দেশসেরা ফুটবলাররা।
দেশকে এত ভালো ভালো ফুটবলার উপহার দিয়েছেন আমিনুল ইসলাম কিন্তু দিন শেষে তিনি কী পেলেন? তার শিষ্যরা জাতীয় দলে খেলেন, এর বাইরে কোনো প্রাপ্তিই তার নেই। এমনকি চাকরি শেষে জীবন ধারণের জন্য পবেন না পেনশন। বিকেএসপি বাংলোদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে তার চাকরি প্রথম শ্রেণির পদমরযাদার হলেও তার মতো চাকরিজীবীদের জন্য এখনও পেনশনের ব্যবস্থা নেই।
কোচ হিসেবে বিকেএসপিতে যোগদানের আগে আমিনুল ইসলাম লেকচারার হিসেবে কাজ করেছেন কাতারের শেখ খলিফা বিন যায়েদ ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে এসেই এখানে কাজ শুরু করেন। তখন তার মাসিক বেতন ছিল ৬ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে নিয়ে কোনোরকমে টেনেটুনে চলে যেত তাদের। এরপর, বেতন বাড়তে বাড়তে এখন তিনি মাসে পান ২৫ হাজার টাকা, যা চাহিদার তুলনায় একবারেই অপ্রতুল!
এ প্রসঙ্গে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এই দুর্মূল্যের বাজারে মাত্র এই কয়টি টাকা দিয়ে সংসার চালাই। খুব কষ্ট হয়। সংসারে উপার্জনক্ষম আমি একাই। এই মুহূর্তে উপার্জনক্ষম কোনো সন্তানও নেই যে অবসরে গেলে আমাকে খাওয়াবে। একমাত্র ছেলে, সেও পড়াশুনা করছে। আর চাকরিরত অবস্থয় যে সীমিত টাকা পেতাম, সেখান থেকে সঞ্চয় বলতে কিছুই করতে পারিনি। একরকম খালি হাতেই চাকরি খেকে অবসরে যাচ্ছি। অনাগত দিনগুলো কীভাবে কাটবে তা ভেবেই পাচ্ছি না। ’
সম্প্রতি বিকেএসপিতে পেনশন বাস্তবায়ন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের কথায় তার কষ্টের মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। ‘শুনলাম মহাপরিচালক মহোদয়ের উদ্যোগে আগামী দুই-তিন বছর পরই পেনশন বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু দেখেন, আমার কি দুর্ভাগ্য, আমি আসছে বছরই আবসরে যাচ্ছি। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের কাজের জায়গা, সহকর্মী ও শিষ্যদের ছেড়ে যাবার কষ্টতো থাকছেই। ’
১৯৭২ সালে খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু হয়েছিল আমিনুল ইসলামের। সময়টি যে বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল তা ভক্তদের বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। দেশের বাড়ি বগুড়া জেলার সাড়িয়াকান্দিতে হওয়ায় খেলোয়াড়ি জীবনের প্রথম দিকে জেলাভিত্তিক ফুটবল খেলেছেন, তখন তিনি স্কুল শেষ করে কলেজে পড়ছেন। ১৯৭৬ সালে ভর্তি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে থেকেই তার শুরু হয় জাতীয় পর্যায়ে থেকে শুরু করে পেশাদার লিগে খেলা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ১৯৭৭-৮২ সাল পর্যন্ত খেলেছেন শের-ই-বাংলা জাতীয় ফুটবল লিগ। ক্লাব ফুটবলেও কম যাননি তিনি, খেলেছেন দেশের ঐতিহ্যবাহী আবাহনীতে। তবে, তখনকার ফুটবল আর এখনকার ফুটবলের মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পান না আমিনুল।
‘খেলোয়াড়ি জীবনে যে ফুটবল আমি দেখেছি, এখন আর তা দেখি না। আমাদের দেশের এখনকার ফুটবল ও ফুটবলারদের দেখে শুধুই হতাশ হই কারণ আমাদের ফুটবল এখন আগের চাইতে অনেক পিছিয়ে গেছে। সেই ৮০’র দশকে ফুটবল যেমনটি আমি দেখেছি তেমটি আর নেই। ওই সময় খেলোয়াড় হিসেবে যে দাম পেতাম, এখন কোচ হয়ে তা পাচ্ছি না। যেখানেই যাই নিজেকে কেমন মূল্যহীন মনে হয়’- হতাশকণ্ঠে বলেন আমিনুল।
কেন আমাদের ফুটবল আগের অবস্থায় নেই আর এখান থেকে বের হতে হলেই বা কী করতে হবে? -এমন প্রশ্নের জবাবে বিকেএসপিএর হেড কোচ বলেন, সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই বদলায়। এখনকার ফুটবল আর আগের মতো নেই। আধুনিক ফুটবল অনেক বিজ্ঞানসম্মত। এখন গবেষণাসহ আছে তাত্ত্বিক অনেক বিষয় আলোচনা ও পরযালোচনার, যা আমাদের দেশে নেই।
পাশাপাশি তিনি এদেশে ফুটবলের গোড়ায় গলদের বিষয়টিও বলতে ভুলে গেলেন না। বললেন, আমাদের দেশে ফুটবলারদের শুরুটা আরও অল্প বয়সে হওয়া উচিত। শুরুটা অনুর্ধ্ব-১০, ১২ থেকে হলে সবচাইতে ভালো হয়। তাতে করে আমাদের ছেলে মেয়েদের শারীরিক উন্নতিসহ মানসিক উন্নতিও হবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ টানলেন বিদেশি ফুটবলারদের। ছোটবেলা থেকেই তারা একাডেমিতে ভর্তি হওয়ায় খ্যাদ্যাভ্যাস সঠিকভাবে গড়ে ওঠে। ফলে তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে ভালোভাবে খেলাটি রপ্ত করতে পারে।
একই বিষয়ে আমাদের দেশের একাডেমি এবং প্রচলিত ক্যাম্পিং ব্যবস্থা নিয়েও তিনি হতাশ। কারণ, দেশে টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র ৩ মাস আগে ক্যাম্পিং শুরু হয়। ক্যাম্পে এসে খেলোয়াড়দের খাপ খাওয়ানোসহ ঘোরাঘুরিতে যায় ১ মাস, বাকি খাকে ২ মাস যা একটি প্রতিযোগিতায় ভালো ফলাফলের জন্য পর্যাপ্ত নয়।
আরো একটি বিষয়ের প্রতিও আলোকপাত করেন এই কোচ। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতিগতভাবেই আমরা বিদেশিদের চাইতে শারীরিকভাবে পিছিয়ে। তাই দীর্ঘ মেয়াদে ছেলেমেয়েরা একাডেমিতে সঠিক খ্যাদ্যাভ্যাস ও নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে খাকলে বিদেশিদের চাইতে শারীরিকভাবে পিছিয়ে থাকবে না।
এ ব্যাপারে একাডেমিগুলোকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি ফুটবলের জন্য নতুন নতুন অবকাঠামো গড়ে তোলার ব্যাপারেও মত দেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফুটবল কোচ।
আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, বেশি বেশি একাডেমি করে দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে খেলোয়াড়দের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সঙ্গে একাডেমির খেলোয়াড়দের সঠিক পরিচর্যা ও বেশি বেশি খেলার আয়োজন করতে হবে।
এ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে পারলেই বাংলাদেশের ফুটবল এগিয়ে যেতে পারবে বলেও বিশ্বাস করেন আমিনুল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
এমজেএফ/
** একই মাঠে ফুটবলার-ক্রিকেটারের মিলনমেলা
** সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্রিকেট উত্তাপ