ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মৌলভীবাজারের ৩ পাহাড়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৮ ঘণ্টা, জুন ৪, ২০১৯
অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মৌলভীবাজারের ৩ পাহাড় অ্যাডভেঞ্চারের জন্য মৌলভীবাজারের ৩ পাহাড়

মৌলভীবাজার: আপনার ঈদ ভ্রমণের আগ্রহ যদি পাহাড়কে ঘিরে হয় তাহলে এই সময় পাহাড়ের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা সব সৌন্দর্য উপভোগ করুন। বিষয়টা যদি এমন হয়, এক্সট্রিম অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং ট্রেইলের করতে করতে হঠাৎ ঝরনার মুখোমুখি হলেন? তবে আপনার জন্য পাহাড় তার রূপের ডালি মেলে ধরলেও পাহাড়ে যাওয়ার ছুটি পান ক’জনের?

অনেকে আবার আক্ষেপ করে বলেন ‘আহারে আহারে, কবে যাব পাহাড়ে’ কিন্তু না এবার আপনি পাহাড়ে অনায়াশে যেতেই পারেন। কারণ আপনার হাতে আছে ঈদের ছুটি।

তাহলে বেরিয়ে পড়ুন পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারের তিন পাহাড় দর্শনে।

কালা পাহাড়:

কালা পাহাড়কে বাংলাদেশের অন্যতম সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্খ বলা হয়। মৌলভীবাজারে কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে অবস্থিত কালা পাহাড় উচ্চতায় এক হাজার একশ ফুট। এই পাহাড়ের ৬০ শতাংশ বাংলাদেশে আর বাকি অংশ পড়েছে ভারতের উত্তর ত্রিপুরায়। কালা পাহাড়কে স্থানীয় ভাষায় ‘লংলা’ পাহাড় নামে ডাকা হয়। এছাড়াও এই পাহাড়কে ‘হারারগঞ্জ পাহাড় নামেও ডাকা হয় বলে জানা গেছে। এটি মূলত এক্সট্রিম অ্যাডভেঞ্চার ট্রেকিং ট্রেইলের ট্রিপের জন্য বেষ্ট ডেস্টিনেশন। অঘোষিতভাবে এটাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে অনেক আগে থেকে ধরা হলেও কালা পাহাড়ের সৌন্দর্য সম্প্রতি ব্যাপকভাবে সামনে এসেছে। কারণ এই পাহাড়ে যাওয়ার সময় আপনি পাবেন অপূর্ব সুন্দর আজগরাবাদ চা বাগান, আদিবাসীদের জীবনচিত্র, সমাহরিত বন, হরেক রকম বৃক্ষরাজি, বন্যপ্রাণীসহ দূর থেকে অবলোকন করতে পারবেন নীলাভ হাকালুকি। এখানেই শেষ না, আরও ট্রেকিং করতে চাইলে কালা পাহাড়ের উল্টো দিকে মুড়াইছড়া ইকোপার্ক হয়ে জুড়ী উপজেলায় ফুলতলা হয়ে বের হতে পারেন। এক কথায় একদিনের এক্সট্রিম ট্রেকিংয়ে জন্য এরচেয়ে আদর্শ জায়গা আর হতেই পারে না। কালা পাহাড়কিভাবে যাবেন:

ঢাকা থেকে আপনাকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া আসতে হবে। হানিফ, শ্যামলী বাস কিংবা ট্রেনে কুলাউড়া এসে নামবেন। কুলাউড়া শহর থেকে কালা পাহাড়ের দূরত্ব আনুমানিক ৩৫ কিলোমিটার। প্রথমে যেতে হবে গাড়িযোগে রবিরবাজার হয়ে আজগরাবাদ চা বাগানের গেটে। লোকাল গাড়িতে গেলে ৪০ টাকার মতো খরচ পড়বে। রিজার্ভ করলে ৩/৪শ’ টাকা।   সেখান থেকে প্রায় ৪০ মিনিট পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হবে বেগুন ছড়া খাসিয়া পুঞ্জিতে। আদিবাসী পুঞ্জির মন্ত্রীকে (প্রধান) বলে গাইড নিয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাবেন কালা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়।

কুরমা বনবিটের হামহাম:

‘হামহাম’ শব্দটা শুনেই বুঝেছেন নিশ্চয় আমি খুব পুরিচিত একটি স্থানের কথা বলছি। হ্যাঁ, তা ঠিক ধরেছেন তবে কেন বলছি হয়তো বুঝেছেন? হামহামের যাত্রায় শুধু মাথায় ছিলো ‘আহারে আহারে কোথায় সে ঝরণারে’। কিন্তু এবার একটু পাহাড়কে উপভোগ করুন। বর্ষায় হামহামের ভর যৌবন আর পাহাড়ের সজীবতা পাওয়া যায়। তবে এ যাত্রায় তার জন্য ঝরনার কথা ভুলে যেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে আসুক ঝরণা দেখি কেমন লাগে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে কুরমা বনবিট এলাকা। এই বিটের মাঝখান দিয়ে পর্যটকদের হামহামের গন্তব্যে হাঁটতে হয়। পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথের ধারে প্রকৃতি তার শৈল্পিক নিদর্শন সাজিয়েছে। দুই ঘণ্টার যাত্রায় একটা বিরতির কথা ভাবলেই পথের ধারে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা অর্জুন গাছটাই চোখে লাগবে। কুরমা বনবিটের হামহামযতটা সামনে এগিয়ে যাবেন বুঝতে পারবেন প্রকৃতি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে নানা বৈচিত্রতায়। হামহামের নিকটবর্তী ‘পবন’ টিলায়ে এসে একবার থেমে যান। শুধু মাথায় রাখবেন হাঁটতে হাঁটতে কত উপরে যাচ্ছেন আপনি। একসময় দেখবেন আপনিই সব থেকে উপরে আছেন। সেটাই কুরমার ‘পবন টিলা’। দূরে সাঁ সাঁ ঝরনার শব্দ পাবেন। ঠিক সে মুহুর্তে আশপাশকে দেখুন আর ভাবুন কত পথ পেছনে ফেলে এসেছেন। পথের শেষ হবে কিন্তু এই সবুজের সমারহ যেন ফুরাবার নয়। সামনের সামন বলতে এখন চির সবুজ অরণ্যের দেয়ালে ঘেরা একটি মায়াবী ঝরনা ‘হামহাম’। এই পবন টিলায় এসে একটা বিরতি নিয়ে নেমে পড়ুন পাহাড়ী ঝিরি পথে। ঘন জঙ্গলের ঢাকা ঝিরি পথের প্রবাহিত পানিতে পা ভিজিয়ে আপনার স্বর্গকে এখানে কল্পনা করতে পারবেন। এ পথে হাঁটতে গিয়ে কানে আসবে কোকিলের সুর আর ঘুঘুর কানপাকানী ডাক। এর মধ্যে মায়া হরিণের দৌঁড় কিংবা বানর দলের হুল্লোড় দেখতে পারেন। এসব দেখতে দেখতে সামনে ভেসে উঠবে মায়াবী এক ঝরনা।

কিভাবে যাবেন:

আপনি বাস বা ট্রেনযোগে কমলগঞ্জ যেতে পারেন। রেল যোগযোগকে বেছে নিলে সিলেটগ্রামী যেকোনো ট্রেনে ভানুগাছ স্টেশনের টিকিট করে নেবেন। সেখানে নেমে যেকোনো সিএনজি ভাড়া করতে পারেন কুরমা চম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত। ভাড়া নেবে ৩/৪শ টাকা। অথবা আপনাকে উপজেলার সামনে এসে সেখান থেকে সার্ভিস গাড়িতে আদমপুর বাজার পর্যন্ত যেতে পারবেন। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করা লাগবেই। কুরমা বিট কার্যালয়ের সামনে গিয়ে একজন গাইড নিয়ে হাঁটতে শুরু করবেন হামহামের উদ্দেশ্যে। যাত্রা পথে সময়টা শুধু খেয়ালে রাখবেন।

পাথারিয়া পাহাড়:

মৌলভীবাজার জেলা দীর্ঘ সার্কেল ‌'হিল' বলা হয় পাথারিয়া পাহাড়কে। মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় এর অবস্থান। এই পাহাড়টি ২৪ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। এটি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পূর্ব দিকের সীমান্তবর্তী খাসিয়া-জয়ন্তীয়া উচ্চভূমির একটি বর্ধিত অংশ। এর অপর অংশ ভারতের আসামে রাজ্য। পাথারিয়ার উঁচু চূড়া উঠলে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের করিমগঞ্জ জেলা শহর চোখে ভাসে। পাথারিয়া পাহাড়ের আদি নাম ‘আদম আইল’। এখন স্থানীয় বাসিন্দারা সে নামে এই পাহাড়কে চিনেন। মূলত এই পাহাড়ের উপর থেকে পতিত পানিতেই সৃষ্টি হয়েছে এশিয়ার অন্যতম বৃহত জলপ্রপাত ‘মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত’। এই পাহাড়ের বিশাল এলাকায় আরো কয়েকটি ছোট ছোট ঝরনা রয়েছে। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য সর্বোচ্চ প্রাপ্তি হচ্ছে পাথারিয়া পাহাড়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে যেতে পারেন বুনো ঝরনার দেখায়। পাথারিয়া পাহাড়মূলত ঝরনাই পাথারিয়া পাহাডড়ের প্রতি আপনার অন্যরকম আকর্ষণ এনে দেবে। এই পাহাড়ে আছে ঝেরঝেরি, কাখড়া ছড়ি, পুছুমকুন্ড, ফুল ঢালনি ঝেরঝেরি আর ইটাউরি ফুলবাগিচা ঝরনা। উঁচু-নিচু টিলা সবুজ বৃক্ষরাজির সমাহারিত পাহাড়ের বুক চিরে বেরিয়ে আসা প্রবাহমান পানি ছড়া দিয়ে সমতলে নেমে আসছে। এমন দৃশ্য দেখলেই বুঝতে পারবেন আপনি কোনো না কোনো ঝরনার কাছে এসে গেছেন।   দুর্গম এই ছড়া দিয়ে হেঁটে ঝরনার কাছে যেতে যতো বিপত্তি ক্লান্তি আসুক না কেন, ছড়ার স্বচ্ছ শীতল পানি, চারদিকের সবুজ প্রকৃতি, পাখির কলতান সব ক্লান্তি দূর করে দেবে আপনার। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এসব ঝরনায় গা ভাসাতেও পারবেন।   পাথারিয়া পাহাড়ে গেলে অবশ্যই পাথারিয়া তেল কুপটি দেখে আসবেন। ১৯৩৩ সালে তৎকালীন সরকার বার্মা ওয়েল কোম্পানিকে (বিওসি) দিয়ে এখান থেকে তেল উত্তোলনের ব্যবস্থা করে। পরবর্তীকালে তেলের পাইপ ফেটে যায় এবং স্থানীয় পুরো এলাকা তেলের জোয়ারে ভাসতে থাকে তিনদিন। এই তেলকূপ বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও এখনও এর ভেতর তেলের মজুদ আছে। সেখানকার মাটি থেকে এখনো তেলের গন্ধ আসে।

কিভাবে যাবেন:

মৌলভীবাজার জেলা থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে পাথারিয়া পাহাড়। ঢাকা থেকে ট্রেনে এবং বাসে দুই মাধ্যমেই যাওয়া যায়। বাসে হলে সোজা বড়লেখা যেতে পারবেন হানিফ বা শ্যামলী পরিবহনের মাধ্যমে। ট্রেনে যেতে চাইলে কমলাপুর থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর ট্রেনে কুলাউড়ায় নেমে তারপর বাসে অথবা সিএনজি নিয়ে বড়লেখা সদরে নামতে হবে। সেখান থেকে ডিমাই এলাকায় যেতে হবে। একমাত্র মাধ্যম সিএনজিচালিত অটোরিকশা আবার মাঝেধ্যে চাঁদের গাড়ি পাওয়া যায়। ডিমাই থেকেই স্থানীয় কাইকে গাইড নিয়ে নিলেই সে আপনাকে পুরো পাথারিয়ায় চরিয়ে বেড়াবে। পাথারিয়া পাহাড়আপনি থাকবেন যেখানে:

যেহেতু আপনি ঈদের ছুটিতে যাবেন সেক্ষেত্রে আপনি চাইবেন এই পাহাড় বাদে মৌলভীবাজারের আরও দু'একটি স্থানে ঘুরে আসতে। কারণ এই পর্যটন জেলায় পাহাড় ছাড়াও আরও অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। আপনার রাত্রিযাপনের জন্য উত্তম জায়গা হলো মৌলভীবাজার জেলা সদর। যদি তার কোনো একটি পাহাড়েই আপনার ভ্রমণ সীমাবদ্ধ হয় তাহলে প্রতিটি উপজেলা শহরে মোটামুটি মানের হোটেল পাবেন সেখানে উঠে যেতে হবে। আর মৌলভীবাজার শহরেই থাকলে আপনার জন্য ভালো মানের হোটেল হচ্ছে রেস্ট ইন, ওয়েস্টার্ন হোটেল, কায়রান হোটেল, রাঙাউটি রিসোর্ট ও ইকো রিসোর্ট। এদের স্বনামে ওয়েব সাইট রয়েছে সেখান থেকে বুকিং করে নিতে পারেন। যেহেতু পাহাড় ভ্রমণে যাবেন সেক্ষেত্রে আপনার নিরাপত্তা বা অনন্যা সুবিধার কথা ভেবে ‘উচ্ছ্বাস ট্যুরিজম’ এর সহায়তা নিতে পারেন। তাদের ফেসবুক বা ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করলেই বিস্তারিত পেয়ে যাবেন।

পাহাড়ের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি ও সতর্কতা:

• ট্রেকিং এর জন্যে ভালো গ্রিপের জুতো ব্যবহার করবেন

•  পাহাড়ে জোঁক থাকে, সঙ্গে একটু লবণ রাখবেন যাতে জোঁক ধরলে ছাড়ানো যায়।

• ব্যাকপ্যাক যতোটুকু সম্ভব হালকা রাখবেন।

• পর্যাপ্ত পানি ও খাবার স্যালাইন নেবেন।

• পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথ, চলার সময় সাবধান থাকবেন।

• ফার্স্ট এইডের জন্যে যা প্রয়োজন সঙ্গে রাখবেন।

• ঝরনা ও ট্রেইলে দয়া করে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।

• স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করুন।

• কোনো খনিজ সম্পদ বা পাহাড়ের জিনিস নিয়ে আসার কথা না ভাবাই ভালো।

• সময়ের দিকে খেয়াল রাখুন যেন ফিরে আসার পথেই সন্ধ্যা না হয়ে যায়।

• আর হে, আপনি কোথায় যাবেন, কিভাবে যাবেন তা আগ থেকেই পরিকল্পনা করে বের হন।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৩ ঘণ্টা, জুন ০৩, ২০১৯
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।