ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

নেপালের ডায়েরি-৩

ভোর পাঁচটায় স্কুল শুরু

জেসমিন পাপড়ি, ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৪
ভোর পাঁচটায় স্কুল শুরু

পোখারা থেকে: শিরোনাম দেখেই ঘাবড়াবেন না। এ ব্যবস্থা বাংলাদেশে নয়।

সূর্য ওঠার আগেই স্কুলে পৌঁছানোর এই নিয়ম হিমালয়কন্যা নেপালে।

যেন ‘সকাল সকাল ঘুম আর সকাল সকাল ওঠা’র প্রবাদটি এদের জন্যই তৈরি। এই প্রবাদের ব্যবহার দেখলাম নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরের শহর পোখারায় এসে। অবশ্য প্রথম দিন কাঠমান্ডু ঢুকে রাত নটাতেই খাবার খুঁজে না পেয়ে কিছুটা আঁচ করেছিলাম। কিন্তু পোখারা এসে অন্ধকারে দল বেঁধে ছেলে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া দেখে অবাক না হয়ে পারিনি।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে অন্নপূর্ণা পর্বতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হোটেল থেকে রওনা দিতে হল ভোর পাঁচটায়। পথে যেতে দেখা গেল দল বেঁধে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। তখনও অন্ধকারই কাটেনি। নিশ্চিন্ত মনে তারা হেঁটে যাচ্ছে স্কুলের দিকে।

জানতে পারি এই পাহাড়ে সন্ধ্যা দ্রুত নামার কারণেই এই ব্যবস্থা। দুটি শিফটে স্কুল চলে। ভোর পাঁচটা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রথম শিফট। এরপরের শিফট বেলা ১১টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত। তবে অফিস আদালতের সময় সকাল নটা থেকে পাঁচটা।

ট্যাক্সি ড্রাইভার চিত্র জানালো-এখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী এক শিফটে স্কুল করার পর অন্য শিফটে বিভিন্ন ধরনের খণ্ডকালীন চাকরি করে। বিশেষ করে হোটেল এবং বিভিন্ন দোকানে। এটার সঙ্গেও আমার দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে মেলাতে পারছিলাম না।

অন্নপূর্ণায় আগুন
এসব কথার মাঝেই কখন যেন চলে এসেছিলাম অন্নপূর্ণার খুব কাছাকাছি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখলাম কি ভয়ঙ্কর উচ্চতায় পৌঁছে গেছে আমাকে বহনকারী ট্যাক্সি। পাহাড়ি চিকন রাস্তা থেকে এক পলক নিচে তাকিয়ে মনে হল পোখারা শহরের বড় বড় বাড়িগুলো যেন কেমন খেলনার মত ছোট হয়ে গেছে। শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। একসময় ট্যাক্সি থামিয়ে চিত্র জানাল, দিদি, পৌঁছে গেছি। সামনে একটু হেঁটে গেলেই অন্নপূর্ণার চূড়া দেখতে পাবেন। তখনও অন্ধকার কাটেনি। তাই বুঝে উঠতে পারিনি কি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে আমার।

ট্যাক্সি থেকে নামতেই একজন তরুণ এগিয়ে এসে জানতে চাইল গাইড লাগবে কিনা। মুহূর্তের সিদ্ধান্তে তাকে সঙ্গী করলাম। মাত্র তিনশ’ টাকার বিনিময়ে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল রাম নামের গাইড। একা এসেছি শুনে তারও বিস্ময়ের শেষ নেই যেন।

কুয়াশা মাখা ভোরে রামের দেখানো পথে চললাম সারেং কোঠার শীর্ষে। উঠতে হল আরো প্রায় দোতলার সমান। সেখানে তৈরি এক বিল্ডিংয়ে ছাদে জায়গা পাওয়া গেল একশ’ টাকার বিনিময়ে।

যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম সেটা আসলে এখনই। শ’দুয়েক পর্যবেক্ষকের দলে ভিড়ে আমিও দেখছিলাম দূরে, কিন্তু যেন খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা অন্নপূর্ণাকে। সাদা বরফের পোশাক পরিহিত অন্নপূর্ণার রূপ দেখে যেকারোরই আনন্দে ভেসে বেড়ানোর কথা। শতশত ক্যামেরা কাজ করছে। হঠাৎ এক মুহূর্তে চোখ আটকে গেল অন্নপূর্ণার চূড়ায়। আগুন ধরেছে সেখানে। সেই আগুনের ঝলকানিতে ঝলসে যাচ্ছে অন্নপূর্ণার বরফের পোশাক। কি এমন ঘটল সেখানে। গাইডের ডাকে চোখ ফেরাই পুবের আকাশে। কি ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য সেখানে। পাহাড় আর মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে সূর্য। আর তার লাল তেজস্বি রশ্মিটাই অন্নপূর্ণার শরীরে আগুন হয়ে জ্বলছে। প্রকৃতি তার একটি সৌন্দর্যের সঙ্গে আরেকটিকে কেমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে এ দৃশ্য দেখে আরো নতুনভাবে সেটি উপলব্ধি করলাম। ছবি তোলার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। সেকথা স্মরণ করালো গাইড রাম। এরপরে আর সময় নষ্ট করিনি। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে আবারও রামের ডাক। না এবার অন্য কোন সৌন্দর্য দেখার জন্য নয়। ফেরার তাড়া। ফিরতে হল অন্নপূর্ণাকে ছেড়ে। কিন্তু প্রকৃতি আমার মনের কোণে অন্নপূর্ণার যে সৌন্দর্য গেঁথে দিয়েছে তাকে বিদায় দিতে পারব না এই জীবনে। এ অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর কিন্তু বড্ড বেশি সুন্দরের।

ফিরলাম একই ট্যাক্সিতে। পনেরশ’ টাকার বিনিময়ে পোখারা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে সারং কোট গিয়ে অন্নপূর্ণ দর্শন মেলে আমার। ড্রাইভার চিত্র জানালো, একাধিক মানুষ হলেও ভাড়া একই। আপনি একা না এসে দল বেঁধে এলেই কম খরচে আসতে পারতেন।

সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই চিত্র আমাকে ফিরিয়ে আনল হোটেলে। পথিমধ্যে সে আমাকে ঘুরিয়ে আনল মাহেন্দ্র গুহা থেকে। গুহাটিতে প্রবেশ মূল্য মাত্র ত্রিশ টাকা। কিন্তু গুহা পথে চলতে হবে বেশ সাবধানে। না হলে পিচ্ছিল পাথরে আমার মত ধপাস করে পড়ে ব্যথা পেতে হবে।

এখানেই শেষ নয় পোখারা
অন্নপূর্ণা দেখাতেই শেষ নয় পোখারা দেখা। বাকি রয়ে গেলো ডেভিস ঝরণা, সেতি নদী, শান্তি প্যাগোডা আর গোর্খা মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। শান্তি প্যাগোডা ‍দূরে হওয়ায় বাদ দিতে হল সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা। টাক্সি ছেড়ে দুপুরের একটু আগে নিজে হেঁটেই বেড়ালাম পোখারা শহরে। ট্যাক্সি ভাড়া বাঁচানোর চেয়ে মূল উদ্দেশ্য শহরটি হেঁটে দেখা। প্রায় তিন থেকে চার কিলো হেঁটে চলে এলাম ডেভিস ফল। বহু বছর আগে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে এসে ডেভিস নামের এক সুইস নারী এই ঝরণায় ডু্বে মরার পর থেকেই এই ঝরনার নাম হয়েছে ডেভিস ঝরণা।

ত্রিশ টাকার টিকিটে ঢুকেই দেখতে পাবেন পুরো এভারেস্ট। তবে সেটা প্রকৃতির হাতে নয়, শিল্পীর হাতে তৈরি। একটু এগিয়ে যেতেই গর্জন। ডেভিস ঝরনার পানির গর্জন। সে পানির তীব্রতা দেখেই আন্দাজ করা যায় সামর্থ থাকলে নেপাল বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তি হতে পারে। দেখতে বেশ সরু লাগলেও পানির এমনই তীব্রতা যে, একবার কেউ তাতে পড়লে মুহূর্তেই হারিয়ে যাবে গভীর খাদে। ডেভিস ঝরনার ১০০ মিটার দূরে আরেকটি বিরাট গুহা। ১০০ রুপির বিনিময়ে দেখে আসতে পারেন সেটিও। ডেভিস ঝরনার পানি এখানেই এসে পড়ছে। মাটির অনেক অনেক নীচে চলে গেছে গুহাটি। উপরে একটা মন্দির আছে। গুহার দেয়াল চুঁইয়ে অনবরত পানি পড়ায় জায়গাটি স্যাঁতসেঁতে। বহুদূর থেকে ভেসে আসা পানির কলকল শব্দও পাওয়া যাবে। টিমটিম করে জ্বলা বাল্বের আলোয় অনেকক্ষণ নামার পর যখন মনে হবে বহুপথ চলে এসেছি, তখনও অর্ধেক নামা হয়নি। এরপর স্বল্প আলো, ভেজা দেয়াল হাতড়ে সরু পথ চলে আরো অনেক নিচে যাওয়ার পরই দেখা মিলবে ডেভিস ঝরনা থেকে ধেয়ে আসা পানি। যেন আরো দ্বিগুণ গতিতে পড়ছে।

গুহাটি দেখে আবারও একটি বাস ধরে হাজির হই সেতি নদীতে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এটি খাল বৈ কিছুই নয়। কিন্তু পার্থক্য এর সাদা পানি আর গতিতে। এই গতি ধরেই সেখানে তৈরি হচ্ছে ১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যা দিয়ে চলছে পোখারা শহর। যদিও এই বিদ্যুৎ মেটাতে পারেনা পুরো পোখারার চাহিদা। তাই পুরো নেপালের মত এখানেও বেশ লোড শেডিং। শেষ বিকেলে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে আমায় ডেকে বের করেন এখানকার এক কর্মকর্তা। আজকের মত বন্ধ হবে এটি। জানতে চাইলাম আমার গন্তব্য লেক পাড়ে যাওয়ার উপায়। একটু অপেক্ষা করতে বলে নিজেই মোটর সাইকেল নিয়ে হাজির হলেন। আপত্তি করায় জানালেন তিনি সরকারি কর্মকর্তা। আমি ট্যুরিস্ট বলেই সাহায্য করছেন। অবশেষে তার সাহায্য এবং কিছুটা বাসে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাই।

তবুও শেষ হল না পোখারার কথা
নেপালের সবচেয়ে শান্তিময় শহর এই পোখারা। ফেওয়া লেকের মমতায় গড়া স্বাপ্নিক শহর এটি। পোখারায় ঢুকতেই মনে হল শিল্পীর আঁকা ছবির ফ্রেমে এসে পড়েছি। পাহাড়ি রাস্তা ধরে ছোট ছোট বাড়ি ঘর। কিন্তু অপূর্ব সব ডিজাইন, ফুল বাগানে ভরা। পরিষ্কার রাস্তাঘাট। রঙিন বাহারি সব দোকানের মেলা।

প্রথম দিন এসেই ঘুরে নিয়েছিলাম এই ফেওয়া লেক। এই লেক ভিউ দেখার জন্য নিতে পারেন লেক পাড়ের হোটেল। কাঠমান্ডুর তুলনায় বেশ খরচ করতে হবে এই শহরে। হোটেল ভাড়া বাদ দিয়ে অন্নপূর্ণা এবং বাকি অন্যান্য সাইট পরিদর্শনের জন্য মোট খরচ হতে পারে তিন থেকে চার হাজার টাকা। ফোয়া লেকের স্বচ্ছ পানিতে নৌকা চড়ার সুবিধাও আছে।

পোখারা আসা এবং যাওয়া
বলেছিলাম পোখারা আসার পথে বাস মিস করার কথা। মিনিট পাঁচেক পরে এসেই হারিয়ে ফেললাম ৯৫০ রুপির টিকিটের বাস। অবাক করে দিয়ে অন্য এক কোম্পানির ট্যুরিস্ট বাস টিকিটটি দেখে আমাকে তুলে নিল। আমার বাসকে জানিয়ে দিল তাদের যাত্রীটি নিরাপদে যেতে পারছে। ফেরার উপায়ও একই। তবে ট্যুরিস্ট বাসে না ফিরে সরাসরি মাইক্রোতে ফিরতে পারেন। খরচ মাত্র ৫০০ রুপি।

কাঠমান্ডু থেকে পোখারা মাত্র ২০০ কিলোমিটার পথ হলেও পাহাড়ি ভয়ঙ্কর রাস্তা হওয়ায় সময় লাগে ছয় থেকে আট ঘণ্টা। এক মিনিটেই বাসগুলো প্রায় ৮-১০ বাঁক পার হয়। অবাক কাণ্ড, কোন বাসই তেমন হর্ণ বাজায় না। অথচ মোড়ে মোড়ে তারা একে অপরকে ক্রস করছে দারুণ সাবধানতায়। এই রাস্তা দিয়ে পোখারা যেতে বা আসতে যে কারোই মুখস্ত সকল দোয়া কয়েকবার করে আওড়াতে হবে। তবে দুপাশের সৌন্দর্য দেখে সেসব আওড়াতে ভুলেও যেতে পারেন কখনও সখনও।

** বুক কাঁপানো রাস্তায় যাত্রীদের বাস ধাক্কা
**একা হয়েও একা নই এখানে



বাংলাদেশ সময়: ০৯৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।