ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ধ্বংসের পথে রায়েরকাঠি রাজবাড়ি ও মন্দির

শফিকুল ইসলাম জয়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৫
ধ্বংসের পথে রায়েরকাঠি রাজবাড়ি ও মন্দির ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

পিরোজপুর: বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের অন্যতম পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা পিরোজপুরের রায়েরকাঠি রাজবাড়ি ও  মন্দির।

সাড়ে ৩শ’ বছরেরও বেশি পুরাতন ও অপূর্ব নির্মাণ শৈলীর এ প্রাসাদ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ভাটিয়াল রাজা রুদ্র নারায়ণ রায়।

সে সময় ২০০ একর জমিতে নির্মিত হয় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০টি ভবন।

কিন্তু চরম অবহেলা ও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ না থাকায়  রায়েরকাঠির ঐতিহাসিক রাজবাড়ির মূল্যবান পুরাকীর্তি ধ্বংস হতে চলেছে।

রাজবাড়ি ও মন্দির
পিরোজপুর জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে পৌর এলাকার রায়েরকাঠিতে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই রাজবাড়ি।

শহর থেকে রায়েরকাঠির পুলিশ লাইন পেরিয়ে কিছুটা সামনে ১৬৬৮ সালে নির্মিত কালী মন্দির ও ১১টি মঠ। এরও প্রায় ১০০ গজ সামনে ধ্বংসপ্রাপ্ত ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়ি।

হোক বয়সে যতই পুরাতন, কি জীর্ণ, কি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। মুহূর্তকাল সুউচ্চ মঠ ও রাজবাড়ি দেখেই পর্যটকমাত্র মুগ্ধ হতে বাধ্য। অবচেতনে মনের পটে ভেসে উঠবে এ বাড়ির একসময়ের শৌর্য-বীর্যের রূপ।

প্রচারণা ও পর্যটন সুবিধা না থাকায় এ বাড়িটি দেখতে তেমন লোকের আনাগোনা না হলেও, প্রায় প্রতিদিনই কিছু লোক আসেন এটি দেখতে। ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করেন সপ্তদশ শতাব্দীর এ মনোরম নির্মাণ শৈলী।

ইট-সুঁড়কি দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছে রাজবাড়ির প্রাসাদ ও মঠগুলো। কালের বিবর্তনে প্রায় ধ্বংসের পথে মূল রাজবাড়ির অধিকাংশ ভবন। তবে কালের স্বাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে সুউচ্চ ১১টি মঠ।

এরই একটি মঠে স্থাপন করা হয়েছে ২৫ মণ ওজনের বিশালাকার একটি শিবলিঙ্গ। কষ্টি পাথরের তৈরি এ মহামূল্যবান শিবলিঙ্গটি উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ বলে জনশ্রুতি আছে।

পিরোজপুর জেলার ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে যুবরাজ সেলিম বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলায় আসেন। এরপর তিনি ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ নিয়ে একটি পরগণা সৃষ্টি করেন। নিজের নামে পরগণার নাম রাখেন সেলিমাবাদ।

১৬১৮ সালে সেলিমাবাদ পরগণার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান মদন মোহন। ১৬২৮ সালে মদন মোহন তার ছেলে শ্রীনাথের নামে সেলিমাবাদ পরগণার কিছু জমি নেন। শ্রীনাথ ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে কাচারি স্থাপন করে সেখানেই বসবাস করতেন। এরপর মোগল সম্রাট শ্রীনাথকে রাজা উপাধি দেন। ১৬৫৮ সালে রাজা শ্রীনাথ রায়ের ছেলে রুদ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পিরোজপুরের অদূরে বসবাস শুরু করেন। পরে সেখানে তিনি জঙ্গল পরিষ্কার করে রাজবাড়ি ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বন-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বলেই সেখানকার নামকরণ করা হয় রায়েরকাঠি।

একসময় রাজপ্রথা বিলুপ্ত হলে চালু হয় জমিদারি প্রথা। এতে রাজা রুদ্র নারায়ণ রায়ের উত্তরসূরীরা পরিণত হন জমিদারে। ফলে রায়েরকাঠির এই ঐতিহাসিক স্থাপনাকে কেউ জমিদার বাড়ি, কেউ ‍রাজবাড়ি বলে থাকেন। অমরেন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন এ বংশের শেষ জমিদার।

সরেজমিনে দেখা যায়, ২০০ একর জমি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত  রাজবাড়িটি অযত্নে আর অবহেলার নিঃশেষ হওয়ার পথে। ভেঙে পড়ছে ইট-সুঁড়কি। ক্ষয়ে গেছে দেয়াল। বাড়ির প্রধান ফটক, রাজাদের বসবাসের প্রাসাদ, কাচারি, অতিথিশালা, নাট্যশালা, জলসাঘর, অন্ধকূপ সব কিছুই ধ্বংসের চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে।

মঠগুলো এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও ভেতরের সুঁড়কি খসে পড়েছে। ভবনের গায়ে শ্যাওলা ও আগাছা জন্মে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। রাজবংশের কোনো উত্তরসুরীরা এর দেখভাল না করায় ও সরকারি উদ্যোগ না থাকায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে এককালের এ বৃহৎ রাজত্বের সবর্শেষ চিহ্নটুকু।

এলাকাবাসীর দাবি, ঐতিহাসিক রাজবাড়ি ও মঠ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিক প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এতে একদিকে ঐতিহাসিক স্থানটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে। অন্যদিকে রায়েরকাঠি হয়ে উঠবে দেশের অন্যতম পর্যটন স্থান।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজবংশের ২৯তম পুরুষ সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গৌতম নারাণ রায় চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, রাজবাড়ী ও মঠ সংরক্ষণ কাজের ব্যয় বহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বেশ কয়েকবার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে এগুলো সংরক্ষণের জন্য আবেদন করেও কোনো সাড়া মেলেনি।

যাতায়াতের উপায়
বাসে বা নৌপথে আসা যায় পিরোজপুর। বাসে ঢাকা বা যে কোনো জায়গা থেকে প্রথমে পিরোজপুর শহরে আসতে হবে। সেখান থেকে জনপ্রতি ১০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশা করে রায়েরকাঠি।

ঢাকা থেকে বাসে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ননএসি ৪৫০ টাকা ও এসি ৭০০ টাকা। সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে আসা যাবে পিরোজপুর হুলারহাট ঘাটে। লঞ্চে জনপ্রতি ডেকের ভাড়া ৩০০ টাকা। তবে কেবিন নিতে চাইলে সিঙ্গেল ১ হাজার ও ডাবল বেড ১৯০০ টাকা। হুলারহাট ঘাট থেকে ‍অটোরিকশা করে পিরোজপুর হয়ে রায়েকাঠি। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৫ টাকা। চাইলে রিজার্ভ অটোরিকশাও পাওয়া যাবে।

থাকার ব্যবস্থা
পিরোজপুর সার্কিট হাউজে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকতে পারবেন ১৫০০ টাকার বিনিময়ে। তবে অন্যদের জন্য ভাড়া ১৬০০ টাকা। এছাড়াও শহরে রয়েছে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল। এরমধ্যে অন্যতম হোটেল রিল্যাক্স, এতে এসি ডাবল বেড ১৫০০ টাকা ও সিঙ্গেল বেড ১০০০ টাকা।

বাংলাদেশ সময়: ০০৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৫
এসআর/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।