ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ চূড়ায়-৪

জোঁকে রক্তাক্ত হয়ে আমার দেখা সুন্দরতম পাড়ায়

রিয়াসাদ সানভি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫
জোঁকে রক্তাক্ত হয়ে আমার দেখা সুন্দরতম পাড়ায় ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বান্দরবান থেকে ফিরে: জানালাটা খুলে দিতেই কানে এলো জাতীয় সংগীতের সুর। এই বিরান পাহাড়ি পাড়ায় আমার সোনার বাংলার সুর কানে মধু বর্ষণ করার চেয়ে অবাকই করলো বেশি।

এগিয়ে গেলাম। পাড়ার এক কোণে একটি ছোট্ট স্কুল ঘর। তার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ২৫-৩০ জন পাহাড়ি শিশু। যতটা জোরে গাইলে তা দিগন্তে প্রতিধ্বনিত হওয়া সম্ভব ঠিক ততটাই গলা ফাটিয়ে তারা গাইছে।

পাহাড়ি উপত্যাকায় ঘেরা তাম্লো পাড়ায় শুরু হলো নতুন এক সকাল। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম আজ কিন্তু ঈদের দিন। পরিবার স্বজনদের থেকে অনেক দূরে ভিন্ন ধর্ম, ভাষার মানুষদের সঙ্গে ঈদের দিনের শুরু হলো। ভাবলাম নিজের বাড়িতে থাকলেও কি দিনের শুরুটা এত সুন্দর হতো।   হয়তো হতো, কিন্তু আমার কাছে এটিই সেরা।

বাচ্চা কাচ্চা বাহিনীর সঙ্গে সেলফি তোলার পর্ব শেষ করতে করতে তৌহিদের তাড়া। খেয়েই রওয়ানা দিতে হবে। আগের দিন রেঁধে রাখা শুকনো খিঁচুড়ি ঈদের দিন সকালে আমাদের নাস্তা। এই ভোরে অনেক কষ্টে তা পেটপুরে খেয়ে রওয়ানা দিলাম থানদুই পাড়ার পথে। সঙ্গে আছে আমাদের নতুন গাইড। এই রাস্তা তৌহিদের কাছে নতুন হওয়াতেই এ ব্যবস্থা।

আগের দিন পর্যন্তও বৃষ্টি ছিলো। কিন্তু আজকের সকাল একেবারে রোদে ঝলমল। মনে উঁকি দিয়ে গেলো আশার সূর্য। যে পথে এগোচ্ছি তা শুকনো থাকাটা খুবই জরুরি। কিন্তু কয়েকদিনের বৃষ্টি, তার উপর গয়ালের পাল এই বুনো পথের যা অবস্থা করেছে তা বলার মতো নয়। নরকের রাস্তাও বোধ হয় এমন হয় না। কখনো প্যাঁচপ্যাঁচে কাদায় পা ডুবে যাচ্ছে, কখনো বুনো লতায় পেঁচিয়ে ধরছে শরীর।

এভাবে ঘণ্টাখানেক পথ চলার পর নেমে এলাম এক ঝিরিতে। গাছপালা এমনভাবে চেপে ধরেছে ঝিরির চারপাশটা মনে হয় যেন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সেই ঝিরি ধরে অনেকক্ষণ এগোনোর পর উঠতে হলো জুম খেতের ট্রেইলে। কিন্তু এর অবস্থা আরও খারাপ। পিচ্ছিল ঢালু ট্রেইলে একের পর এক আছাড় খেতে লাগলাম। পায়ের অবস্থা আর নাই বলি। সমানে জোঁকের কামড় আর অবিশ্রান্ত রক্তপাত মনে করিয়ে দিলো আজ কোরবানির ঈদ!

এভাবে বেশ কয়েকটি ঝিরি আর ট্রেইল পেরিয়ে এসে থামলাম বিশাল এক চড়াইয়ের নীচে। ততক্ষণে দিনের প্রথম দুই ঘণ্টার ট্রেকিংয়ের ধকলে ক্লান্ত শরীর। তৌহিদ বললো এর উপরেই নাকি থানদুই পাড়া। চড়াই ভাঙতে সত্যিই বেশ কষ্ট হলো। সেখান থেকে পাড়ায় আসতে লাগলো আরও পনেরো মিনিট। থানদুই পাড়ায় দাঁড়ালাম না। পাড়া ছাড়তেই শুরু হলো আসল খেল। কাদায় পায়ের পাতা পিচ্ছিল হয়ে এমন হলো যে স্যান্ডেলে আর তাল রাখতে পারছিলাম না। আগেরদিন স্যান্ডেলের ফিতে ছিড়েছিলো। তৌহিদ তা আগুনে জোড়া লাগিয়ে দেয়। এবার ছিঁড়লো একেবারে গোড়া থেকে।

খালি পায়েই নামতে লাগলাম। ঠিক হলো নীচের ঝিরিতে নেমে ওর বুট আমি পরবো। কিন্তু ঝিরিতে নামার পর দেখি পায়ের অবস্থা ট্র্যাজিক। দুই পায়ের প্রত্যেক আঙুলে জোঁক লেগে আছে। একেবারে রক্তারক্তি অবস্থা। ঠিকমতো ধাতস্ত হয়ে আবার পা চালাতে হলো। শেষ পর্যন্ত বিশাল চড়াই পেরিয়ে এক বড় ট্রেইলে এসে পৌঁছালাম। সকালে তাম্লো পাড়া থেকে এই অবধি বুনো ট্রেইল পেরিয়ে এসে অবশেষে দেখা পাওয়া গেলো শুকনো খটখটে বেশ প্রশস্ত রাস্তার। উপর থেকে নয়াচরন পাড়ার কিছুটা দেখা যাচ্ছিলো। রেমাক্রির গর্জন এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। এখন একটানা নামা। মাঝে মাঝে বাড়াবাড়ি রকম খাঁড়া, পা টিপে টিপে নামতে হয়।

চারপাশে সব জুমখেত। এর মাঝে জুমিয়াদের মাচাং। প্রখর সূর্যের আলোয় এই ট্রেকে প্রথম দেখা গেলো ত্লাংময়ের চূড়া। আশপাশের সব চূড়া ছাপিয়ে জানান দিচ্ছে সে-ই সবচেয়ে উঁচু। নয়াচরন পাড়া যখন পৌঁছালাম তখন সাড়ে ১২ কি ১ টার মতো বাজে। বিস্কুট খাওয়ার বিরতি নেওয়া হলো। বিদায় দিলাম তাম্লো পাড়ার গাইডটিকেও। সেখানে দেখা হাজরায় পাড়ার কারবারির সঙ্গে। তিনি এলেন আমাদের সাথে পাড়া পর্যন্ত।

নয়াচরন পাড়ার ঠিক নীচেই হাজরায় পাড়া। তবে পাহাড় থেকে কসরত করে নামলেই শুধু হবে না, পেরোতে হবে ফুঁসতে থাকা রেমাক্রিও। কারবারি আমাদের ব্যাগ মাথায় করে পার করে দেওয়ায় কঠিন কাজটি একটু সহজ হলো। হাজরায় পাড়া আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর পাড়াগুলোর একটি। জোৎস্না রাতে রেমাক্রির ধারে ক্যাম্পিং করার শ্রেষ্ঠ জায়গা এটি।

বাংলাদেশ সময়: ০১০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৫
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।