ঢাকা, সোমবার, ১৯ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১০

দেয়ালেরও কান আছে

শিমুল সুলতানা, কান্ট্রি এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
দেয়ালেরও কান আছে ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আগ্রা থেকে ফিরে: কথায় আছে, দেয়ালেরও কান আছে। সিকান্দ্রায় গিয়ে প্রবাদ বাক্যটি যে সত্যি সেটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হন দর্শনার্থীরা।



আগ্রার প্রতাপপুরা থেকে সিকান্দ্রা ১২ কিলোমিটারের মতো রাস্তা। সাড়ে পাঁচশ’ রুপি চুক্তিতে প্রতাপপুরার হোটেল থেকে সিকান্দ্রা হয়ে তাজমহল।
 


প্রথম গন্তব্য সিকান্দ্রা এলাকায় অবস্থিত সম্রাট আকবরের সমাধি। সেখানে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে লন ধরে হাঁটতেই কাছে এগিয়ে এলেন দুই/তিনজন গাইড। তাদের পীড়াপিড়িতে ১০০ রুপিতে চমন নামে এক গাইডকে সঙ্গী করতে রাজি হলাম।
 


ভেতরে প্রবেশ করার পর হাতের ডানে কাচমহল। সম্রাট আকবরের আমলে সিকান্দ্রার এ স্থানটি ছিল গভীর জঙ্গল। সে সময় জায়গাটি মনে ধরায় এখানেই নিজের ও পরিবারের সবার সমাধি করার সিদ্ধান্ত নেন সম্রাট। তার আমলে এ সমাধি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যু হয় তার। পরে ছেলে জাহাঙ্গীর কাজটি এগিয়ে নেন।


সে সময় এ এলাকায় শিকারে এসে এই কাচমহলে থাকতেন জাহাঙ্গীর। কাচমহল থেকে বের হয়ে বেশ কিছুটা হাঁটার পর সমাধির কাছে যাওয়ার প্রথম ফটক।


বিশাল এ ফটক (গেট) পর্যন্ত যেতে অতিক্রম করতে হয় ছোট্ট একটি গেট। লম্বা কাউকে এ গেটের ভেতর দিয়ে যেতে হলে মাথা ঝোঁকাতেই হবে। গেটটি এমনভাবে তৈরি যে সাধারণ উচ্চতার যে কেউ অনায়াসে ভেতরে যেতে পারলেও মনে হবে, এই বুঝি মাথায় লাগলো।


গাইড চমনের বর্ণনায়, ছোট্ট এ গেটটি গড়া হয় আকবরের নির্দেশে। তার ইচ্ছা ছিল, যে এখানে আসবে, তাকেই মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে তবেই ভেতরে যেতে হবে।
 

এ গেটের পরেই রয়েছে ফুল, লতা-পাতার অসাধারণ নকশা করা সুবিশাল একটি গেট। ১৫ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া এ গেটের বিশেষত্ব হলো, নানা রঙের কারুকাজে কোনো রং ব্যবহৃত হয়নি। বিভিন্ন রঙের পাথর কেটে কেটে নকশা করা হয়েছে। গেটের গায়ে কিছু লেখা রয়েছে।
 


এ গেটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এতে রয়েছে পদ্মফুলের মতো ফুল, স্টার ও  ক্রস । যা আকবরি আমলের হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের মেলবন্ধনের পরিচায়ক।
 
এ প্রবেশদ্বারের ভেতরটা আগ্রা-দিল্লিতে দেখা বিভিন্ন সমাধি ও কেল্লার মতোই। গেটের দুই পাশের টানা বারান্দাওয়ালা কক্ষগুলো ছিল আস্তাবল। গেট পর হলেই বিশাল চত্বর। যার দুই পাশে গাছপালাসহ সবুজ ঘাসের বিছানা। যেখানে হরিণ, বক আর কবুতরের নির্ভিক বিচরণ দর্শনার্থীদের নিশ্চিতভাবেই আকর্ষণ করবে।
 

বিশাল চত্বরের মাঝখানে প্রায় একই রকম ভারি ফটকওয়ালা মূল স্থাপনা। যার ভেতরের কারুকাজে ব্যবহার করা হয়েছিল স্বর্ণ। যদিও পরে এক রাজা এসে এ স্থাপনার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ করায় সেই জৌলুস আর নেই।

তবে ব্রিটিশ শাসনামলে মূল নকশার আদলে কিছু অংশ রাঙানো হয়। যা এখনো দৃশ্যমান।  
 

স্থাপনার বাইরে জুতা রেখে কিছুটা ঢালু রাস্তা দিয়ে কয়েক সেকেন্ড হাঁটলেই সম্রাট আকবরের সমাধি। সেখানে আজান দিলে অন্যরকমভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। সমাধির পাশে এক ব্যক্তি দর্শনার্থীদের এ প্রতিধ্বনি শোনানোর জন্য কিছুক্ষণ পর পর আজান দিয়ে থাকেন।
 
সমাধির কাছে দাঁড়িয়ে সোজাসুজি চোখে পড়ে সেই ছোট গেটটি। কিন্তু যে স্থাপনার ভেতরে সমাধিটি অবস্থিত তার বাইরে থেকে সরাসরি ছোট গেটটি দেখা যায় না। এটি সেই সময়ের স্থাপত্যশৈলির অপূর্ব এক নিদর্শন।
 

স্থাপনাটির মাঝ বরাবর আকবরের সমাধি। এর চারপাশের দেয়াল লাগোয়া বড় বড় অনেকগুলো কক্ষ। যার একটিতেও কোনো দরজা নেই। এখানে মোট ৪০ জনকে দাফন করার ব্যবস্থা রেখেছিলেন সম্রাট। প্রতিটি কক্ষের ঠিক মাঝখানে গম্বুজ বরাবর রয়েছে ফলস ফ্লোর। এ ফলস ফ্লোর মূলত ফাঁপা স্থান, যার নিচে কবর দেওয়ার জায়গা রাখা হয়েছে। তবে এখানে শুধু জাহাঙ্গীরের শিশুকন্যা ও আকবরের সমাধিসহ তিন/চারটি সমাধি রয়েছে।    


চমন এসব কক্ষ ঘুরিয়ে দেখানোর সময় জানালেন যে, রূপক অর্থে ব্যবহৃত দেয়ালেরও কান আছে কথাটি এসব কক্ষের ক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। এর একেকটি কক্ষের এক দেয়ালের  কোণ থেকে আস্তে কথা বললে অপর দেয়ালের কোণ থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। এমনকি পাশাপাশি দু’টি কক্ষের একটির দেয়ালের এক কোণায় মুখ রেখে আস্তে কথা বললেও পাশের কক্ষের অপর দেয়ালের কোণ থেকে শোনা যায়। তবে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কথা স্পষ্ট বোঝা গেলেও আওয়াজ কিছুটা আস্তে হয়।


তথ্যটি শুনে প্রথমে বিশ্বাস না হলেও আমি ও আমার সফরসঙ্গী দু’ভাবেই পরীক্ষা করে এর সত্যতা পেলাম। বিষয়টি সত্যিই আমাদের অবাক করেছে। সেই আমলে কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমনটা করা সম্ভব হয়েছে তা জানাতে পারেননি গাইড চমন।
বিশ্বের প্রাচীন কিছু স্থাপনাতে বিশেষ করে প্রাসাদ, দুর্গ ও উপাসনালয়ে শব্দ বিজ্ঞানের এমন সুচারু প্রয়োগ দেখা যায়। কক্ষের ভেতরের গোপন শলা-পরামর্শের খবর পেতে বা প্রহরিদের সতর্ক করতেই তৈরি করা হতো শব্দবাহক খাঁজযুক্ত বিশেষ ধরনের এই দেয়াল।


 ‘দেয়ালেরও কান আছে’ - কথাটা বোধ করি আক্ষরিক অর্থেই খাটে আকবরের সমাধিক্ষেত্রের এই কামরাগুলোর বেলায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
এসআই/এএসআর

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৯: শূন্য সমাধিতে পূর্ণ সিকান্দ্রা, আছেন শুধু আকবর
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৮: আগ্রা দুর্গ: অন্তরে তাজ অন্দরে কারাবাস!
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৭: আগ্রা ফোর্ট: অন্দর মহলে মুঘল ইতিহাস
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৬: দিল্লির পথে পথে

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৫: গালিবের সন্ধানে
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪: নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।