ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত

সংখ্যাতত্ত্বের ‘গণ্ডগোল’ ও একটি বধ্যভূমির আওয়াজ

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
সংখ্যাতত্ত্বের ‘গণ্ডগোল’ ও একটি বধ্যভূমির আওয়াজ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

লালমনিরহাট থেকে: যাচ্ছিলাম সবুজের বুক চিড়ে আরো সবুজের সন্ধানে। শহরের ইট-পাথরের ধূসরতা থেকে সবুজ সমতলের পানে।

ইচ্ছে ছিলো, কাজের অবসরে শিশিরে পা ভেজাবো। গন্তব্য তাই উত্তরে।

যমুনা পার হওয়ার সময় বুক ভরে গেলো গর্বে-অহঙ্কারে। স্বাধীনতার পর আমাদের সবচেয়ে বড় স্থাপনা এ সেতু। উত্তর আর দক্ষিণের সঙ্গে দেশের এ মিলন-সেতু বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। স্বপ্ন এখন ‘পদ্মা’য়। উঠতে চাই আরো ওপরে- ইতিহাস আর হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধারণ করে।

উত্তরে এখন বেশ শীত। ঢাকার মানুষেরা নিশ্চয়ই এখানকার জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করবেন বলে প্রস্তুত হচ্ছেন। ‘আসুন ওদের পাশে একটু দাঁড়াই... মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ আহ্বানে এখানকার শীতার্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন তারা।  

শীত আসে শীত যায়। কিন্তু এখানে ঘোচে না জীবনের বঞ্চনা। গ্রীষ্মের ঘাম যেন সবুজ ফসলের বুকে জমে ওঠা শিশিরবিন্দু। এতে পা ভিজলেও হৃদয় যে শুষ্কই রয়ে যায়।

কয়েক জায়গায় যাত্রাবিরতি দিয়ে অবশেষে রংপুরে পৌঁছালাম। হোটেলে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পায়রা চত্বর থেকে শাপলা চত্বরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে দেখলাম, সংগ্রাম আর জাগরণের রংপুর শহর।

সারা দেশের মতোই এখানকার মানুষের মুখেও আর সবকিছুর সঙ্গে অনিবার্যভাবে থাকে রাজনীতি। রাজনীতির এ আলোচনাচক্রেই চলছে আমাদের দেশ। তবে রাজনীতিতে উষ্ণতাও বেশি, থাকারই কথা। এরশাদের সেই রংপুর আর নেই। রংপুর এখন প্রধানমন্ত্রীর। ‘চাচার দিন শ্যাষ, এখন আপার দিন চলতেছে বুঝছো’- বললেন একজন দোকানি।

নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখতেই আবার সেই রাজনীতি। চোখ আটকে গেলো খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্যের প্রতি।   তিনি বললেন, ‘আজকে বলা হয়, এতো লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে, আসলে কত লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানারকম তথ্য আছে’।

মুক্তিযুদ্ধে কতো লোক শহীদ হয়েছেন তা নিয়ে পাকিস্তানের কিছু কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার ও গবেষক মিনমিনিয়ে বিতর্ক তোলার চেষ্টা করেছেন বৈকি। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। পাকিস্তান সরকারও শহীদদের সংখ্যা নিয়ে তেমন কোনো বক্তব্য দেয়নি। তারা আমাদের বিষয়টি ভুলে যেতে বলেছেন! সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের বাহাস আমাদের সেই পুরনো ঘাকে আবার জাগিয়ে দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ যথাযথভাবেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। চলছে দুই দেশের সরকারের টানাপড়েন।

কিন্তু খোদ একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেত্রী ও মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী খালেদা জিয়ার মুখে এ বক্তব্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতিই একটি অবমাননা। দলটির প্রতিষ্ঠাতা রণাঙ্গনের জানবাজ সৈনিক, সেক্টর কমান্ডার। বিএনপিও দাবি করে, এটি মুক্তিযোদ্ধার দল। জিয়াউর রহমান ও বিএনপির উত্তরাধিকারীর এ বক্তব্য আমাদের উদ্বিগ্ন করে। ভাবি, ভাবীই যদি এ কথা বলেন, ভাতিজা তবে কি বলবেন?

শৈশবে গ্রামে ছিলাম। দাদী-নানী-মাঐদের মুখে ‘গণ্ডগোলের’ কথা শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধকে তারা ‘গণ্ডগোল’ বলতেন। পান-সুপারি চিবিয়ে বয়ান করতেন সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। এ ‘গণ্ডগোল’ তাদের কাছে ছিল একটি দু:স্বপ্ন। তারা তাদের সন্তান-ঝি-জামাইকে হারিয়েছেন এ ‘গণ্ডগোলে’। এ ‘গণ্ডগোল’ তাদের কাছে স্রেফ একটা ঝামেলা নয়। জীবনের বিনিময়ে জীবন ফিরে পাওয়া।

কিন্তু জেনে-বুঝেও মুক্তিযুদ্ধকে অনেকে ‘গণ্ডগোল’ বলেন। অনেকে গণ্ডগোল পাকান- ইতিহাস নিয়ে, শহীদদের নিয়ে সংখ্যা নিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। যারা এ রকম করেন, তাদের মুখে পান না হলেও সুপারি নেওয়ার সময় হয়েছে। পরিবেশ গরম না করে সুপারি নরম করা অনেক ভালো।

গন্তব্য আরো উত্তরে- লালমনিরহাট। রংপুর থেকে সকালেই যাত্রা শুরু করি। কাজ ও দুপুরের খাবার সেরে ফিরবো বগুড়ায়। ঊর্ধ্বতন এক রেল কর্মকর্তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছি গাড়িতে উঠবো বলে। কথা হচ্ছিলো, পুরনো লালমনিরহাট নিয়ে। বললেন, ‘চলুন একটু বামে ঘুরে আসি’। প্রশ্ন করিনি কোথায়? কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়লো কালো একটি প্রাচীরের ওপর। এরকম কালো প্রাচীর কখনো দেখিনি। ‘ওটা কি’ জিজ্ঞেস করতেই চোখে পড়লো একট সাইনবোর্ড। থমকে গেলো পা, স্থির হলো দৃষ্টি।

বহুবার যেতে চেয়েও যাওয়া হয়নি যেখানে। অজানা আশঙ্কা, বেদনা ও অনুভূতির মুখোমুখি হতে ভয়- তাই দূর থেকেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি যার পাদদেশে। আজ মুখোমুখি সেই বধ্যভূমির কালো প্রাচীরের।

লালমনিরহাট মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী লালমনিরহাটকে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত করতে তিনদিক থেকে আক্রমণ করেন। অবশেষে পাকিস্তানি হানাদাররা পিছু হটে। কিন্তু চলে যাওয়ার আগে লালমনিরহাটে চালায় মৃত্যুযজ্ঞ, হত্যাযজ্ঞ।

বিভাগীয় রেলওয়ে প্রাঙ্গনে পাকিস্তানি হানাদার-রাজাকাররা মিলে চালায় গণহত্যা। এতে শহীদ হন প্রায় চারশ’ জন। এখানে শায়িত আছেন রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আরো অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ। এমনকি রেলের অনেক নিরীহ যাত্রীরাও।

গণহত্যা শেষে শহীদদের রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। সেই পুকুরই আজকের গণকবর।

পুরো রেল প্রাঙ্গনেই চালানো হয় এ হত্যাযজ্ঞ। কয়েকজন বলেছেন, পুরো জায়গাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মরদেহ। বধ্যভূমির এ গণকবরটি সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার একটি নমুনামাত্র। কিন্তু বড় সাক্ষী।

বিহারি অধ্যুষিত এ এলাকায় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি তারা নারী ও শিশুদের ওপরও নির্যাতন চালায়। অনেক নারীকে ধরে নিয়ে যায়।

এ রকম আরো অসংখ্য বধ্যভূমি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরো দেশজুড়ে। হারিয়ে গেছে, নাম-নিশানা মুছে গেছে বেশিরভাগেরই। যা আছে হয়তো তাও একদিন হারিয়ে যাবে। তলিয়ে যাবে অট্টালিকা, প্রাসাদ বা অন্যকিছুর গভীরে।

লালমনিরহাটের এ গণকবরটিও হারিয়েই যেতো। সে পথেই যেন এগোচ্ছিলো সবকিছু্। স্থানীয় লোকজন তোড়জোর চালিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছেন একটি বধ্যভূমিকে।

লালমনিরহাটের এ গণকবরটি এখন সংরক্ষিত। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। রাস্তার ওপর দিয়ে আছে একটি গেট, আছে একটি স্মৃতিফলকও। সবকিছুই নতুন হয়েছে। গেট, স্মৃতিফলক আর প্রাচীর করার সময় একটু মাটি খুঁড়েই পাওয়া  গিয়েছিল শহীদদের দেহাবশেষ। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা সে কথাই জানিয়েছেন।

কিন্তু কতোজন শহীদ হয়েছেন এখানে? তিনশ’ চারশ’ নাকি পাচশ’? নাকি আরো বেশি (অনেকের বর্ণনামতে, ৩শ’ ৭৩ জন)? নাকি খালেদা জিয়ার ভাষায় ‘...এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে যে আসলে কতো লক্ষ লোক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। নানা বই-কিতাবে নানারকম তথ্য আছে’।

লালমনিরহাট বধ্যভূমির শহীদ ৩শ’ ৭৩ জনের নামের তালিকা আমরা জানি না। জানার চেষ্টা করেছি বলেও মনে হয় না। প্রশ্ন হলো, ৩শ’ ৭৩ জন যদি জানা থাকে তবে তারা কারা, তা কেন জানবো না?

স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও আমরা শহীদদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা করতে পারিনি। এমনকি পারিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা করতেও। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ড্রয়ারে যদি জাল সনদ পাওয়া যায়, তবে আর কার ওপর ভরসা?

শহীদদের পরবর্তী প্রজন্ম এখনো বেঁচে আছে। এ প্রজন্ম চলে গেলে এ জাতীয় দায়িত্বটি আমরা আর কখনোই পালন করতে পারবো না। কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন শহীদেরা। অস্থি-মজ্জার মতোই মাটিতে মিশে যাবে আমাদের এতো বড় অর্জন-সংগ্রাম।

তাই সংখ্যাতত্ত্বের ‘গণ্ডগোল’ থেকে শহীদদের বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে তাদের রক্তের উত্তরাধিকার- আমাদের সবাইকে। লালমনিরহাট গণকবর থেকে সে আওয়াজই ভেসে আসে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৫
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।