ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’- একটি অনবদ্য কবিতা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর ‌ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৬
‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’- একটি অনবদ্য কবিতা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ উদ্বোধনের সময় এর প্রধান প্রকৌশলী স্যার রবার্ট উইলিয়াম গেইলস আবেগঘন কণ্ঠে বলেছিলেন- ‘যে সেতু নির্মাণ করে দিয়ে গেলাম, উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে এ সেতু চিরযৌবনা হয়ে থাকবে। ’ আজ উইলিয়াম গেইলস নেই, নেই লর্ড হার্ডিঞ্জ।

কিন্তু রয়ে গেছে তাদের অমর কীর্তি।

মানুষ মরে যায়, বেঁচে থাকেন শুধু কীর্তিমানরা। সময়ও হারিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে। শুধু কিছু কিছু মুহুর্ত সামনে এসে দাঁড়ায়, ডেকে নিয়ে যায় শত বছর এমনকি সহস্র বছর আগে। নিজের অস্তিত্বকে জানান দেয়, মনে করিয়ে দেয় ‘ছিলাম’ ‘আছি’ ‘থাকবো’।



রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন,
‘আজি হতে শত বর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি
আমার কবিতাখানি কৌতূহলভরে
আজি হতে শত বর্ষ পরে। ...
আজিকার কোন রক্তরাগ
অনুরাগে সিক্ত করি
পারিব কি পাঠাইতে তোমাদের তরে
আজি হতে শত বর্ষ পরে...’

হার্ডিঞ্জ যেন গেইলের লেখা শত বর্ষ আগের এক কবিতা। এ যেন শত বর্ষ আগের সেই অনুরাগের রক্তরাগ। শত বর্ষ পরের প্রজন্মের জন্য ভালোবাসার এক মহান উপহার। শত অনুরাগ ও আনন্দ অভিবাদন দিয়ে গড়া এক প্রজন্ম সেতু। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হওয়ার সময় অনুভব করছিলাম রবি ঠাকুরের সেই কবিতা আর কল্পনায় ভেসে আসছিল শত বর্ষ আগের সেই মুহুর্তগুলো।
 


হার্ডিঞ্জ ব্রিজে হারিয়ে যাওয়া সেই মুহুর্ত, সেই কীর্তি যা আমাদের নিয়ে যায় শত বর্ষ আগে। যেখানে সময় এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। যে ব্রিজ পার হয়ে আমরা ফিরে যাই শত বর্ষ আগে। এ যেন দু’টি শতাব্দীকে সংযোগকারী এক সেতু। এ যেন বর্তমানের বুকে একখণ্ড হারিয়ে যাওয়া অতীত।  



শৈশব-কৈশোরে সাধারণ জ্ঞানের বইয়ে প্রশ্ন ছিল- বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতু কোনটি? জবাব- হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। এ জবাব প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আজও লেখা আছে। এখন দৈর্ঘ্যে ‘হার্ডিঞ্জ’কে হয়তো ছাড়িয়ে গেছে অনেকে। কিন্তু গৌরবের উচ্চতায় ‘হার্ডিঞ্জ’ আজও শ্রেষ্ঠ।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ প্রথম দেখেছি প্রায় এক দশক আগে। এরপর আরও বার দুয়েক দেখা হয়েছে। রেলওয়ের মোটর ট্রলিতে চড়েও পার হয়েছি এ ব্রিজ।
 

ভালো লাগার সেই অনুভূতি নিয়েই আবারও রেলওয়ে শহর পাকশিতে গেলাম। মোটর ট্রলিতে পাকশি থেকে ভেড়ামারা গিয়ে ফিরতি পথে পুরো ব্রিজটি হেঁটে পার হয়েছি। এ এক অসাধারণ অনুভূতি। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করেছি ব্রিজের সেই সব কবিদের, কারিগরদের।


বিশাল ও অপরূপ সৌন্দর্যপূর্ণ এ ব্রিজ পার হলে আজও মনে হয় গেইলকে। চিরযৌবনা এ সেতু আজও সাক্ষ্য দেয়- গেইল সত্য বলেছিলেন। ২০১৫ সালে শত বছর পূর্ণ করলো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। কিন্তু আজও দেখে মনে হয় যেন সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এক সেতু।  



১৯১৫ সালের ৪ মার্চ, ব্রিটিশ বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য দিন। হিজ এক্সিলেন্সি দি ভাইসরয় অব ইন্ডিয়া ‘ব্যারন হার্ডিঞ্জ পেনসুরস্ট’ এলেন পাকশিতে। খুলে দিলেন বাংলার উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণের যোগাযোগের এক বন্ধ দুয়ার। সংযুক্ত হলো অবিভক্ত ভারতের আসাম ও ইস্টার্ন বেঙ্গল। উদ্বোধন করলেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।


একদিকে পাবনার ঈশ্বরদী-পাকশি, আরেকদিকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা। মাঝে প্রমত্ত পদ্মা যার ওপর দিয়ে চলমান এক রেলসেতু। এশিয়ার অন্যতম দীর্ঘ রেলসেতু এ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। যমুনার ওপরে আজ হয়তো আরো বড় ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। কিন্তু শত বছর আগে ‘হার্ডিঞ্জ’ই ছিল দীর্ঘ সেতু। যমুনার ওপর দিয়ে সিঙ্গেল লাইনে রেল চলে। কিন্তু একশ’ বছর আগে থেকেই হার্ডিঞ্জে ডাবল লাইনে রেল চালু হয়। এজন্য এর গতিকে নিয়ন্ত্রণও করতে হয়নি। যমুনার ওপর দিয়ে কোনোরকম ধীরগতিতে রেল পার হয়। স্থায়িত্ব, স্থাপত্য, প্রযুক্তি ও শৈলীতে অনন্য এ ব্রিজ।


দীর্ঘ ৫ বছরের বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। ১৯০৯ সালে সেতু নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়। ১৯১০ সাল থেকে কাজ শুরু হয়। পদ্মা তখন উত্তাল। তাই আগেই (১৯১০-১১ সালে) সেতু রক্ষা বাঁধের কাজ শুরু হয়।

পরিকল্পনা ও প্রস্তাব হয় আরও আগে। ১৮৮৯ সালে। প্রস্তাব পাস হয় ১৯০৮ সালে। প্রথমে কথা ছিল সিঙ্গেল লাইনের সেতু হবে। পরে ব্রডগেজের ডাবল লাইনই অনুমোদিত হয়। ব্রিটিশরা শুধু রেল পার করেই ছাড়েননি। ভেবেছেন, দুই জনপদের মানুষের কথাও। তৈরি করেছেন হাঁটার সুপ্রশস্ত পথ। এতো প্রশস্ত হাঁটার পথ আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো ব্রিজে নেই। বর্তমানে নিরাপত্তার খাতিরে যদিও হাঁটার পথটি দুই দিক দিয়েই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু আজও এ পথ বহাল তার আগের অবয়বেই।


সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৮১ কিলোমিটার। মূল পায়ারের সংখ্যা ১৬টি, স্প্যানের সংখ্যা ১৫টি আর ল্যান্ড স্প্যানের সংখ্যা ৬টি। প্রতিটি ল্যান্ড গার্ডারের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৭৫ ফুট। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে উচ্চতা বা প্রাসঙ্গিক অন্যান্য তথ্যও সংরক্ষিত আছে। এ সেতু সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্যই আছে পাকশির রেলওয়ে দফতরে। ব্রিজ সংলগ্ন তথ্য বোর্ডেও আছে বেশ কিছু তথ্য।

পাকশি রেল দফতরে সংরক্ষিত আছে বিশাল ভলিউমের নকশা, যেখানে এ ব্রিজের যাবতীয় তথ্যই আছে।

গেইল শুধু রক্ষণাবেক্ষণের উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি। রক্ষণাবেক্ষণের যাবতীয় নিয়ম-কানুন ও পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন। ব্রিজের গায়ে লেখা আছে প্রয়োজনীয় বেশ কিছু তথ্য। নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের সব তথ্যই আছে পাকশি রেলওয়ে দফতরে।

সেতুটি নির্মাণে ঠিকাদার ছিল বিখ্যাত বেইনস ওয়ালটি অ্যান্ড ক্রিক। কোন চুক্তির আওতায় তারা কাজ করেছে তা আজও লেখা আছে ব্রিজের স্প্যানে। একটি ব্রিজ যে কতোটা নিখুঁত হতে পারে, তার অনন্য নজির শত বছরের এ ব্রিজটি।   


১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন পুরোদমে কাজ চলছে, তখন এখানে কর্মী ছিলেন সর্বমোট ২৪ হাজার ৪শ’ জন। ১৯১৫ সালের নববর্ষের দিনই (১ জানুয়ারি ১৯১৫) প্রথম মালগাড়ি দিয়ে চালু করা হয় একটি লাইন।

সেই সময় এর নির্মাণে ব্যয় হয় ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ রুপি বা ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ব্রিজ নির্মাণে নদীর নাব্যতার যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ফলে এ ব্রিজের জন্য পদ্মার নাব্যতায় কোনো প্রভাব পড়েনি। যদিও ব্রিজের উত্তর দিকের বিরাট অংশ জুড়ে এখন চর। কিন্তু এটি হার্ডিঞ্জের জন্য নয়। ক্ষতি যদি কিছু হয়ে থাকে তবে তা ‘লালন শাহ’র জন্য। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, দেশের অনেক নদীইতো আজ মরতে বসেছে।



ব্রিটিশ বাংলার সবচেয়ে বড় অর্জন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। স্বাধীনতার জন্য মানুষকে অনেক বড় অর্জন ও বিসর্জন দিতে হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মিত্র বাহিনী এ ব্রিজে বোমা নিক্ষেপ করে। বিজয়ের শেষ লগ্নে (১১ ডিসেম্বর) আহত হয় ‘হার্ডিঞ্জ’। বোমার আঘাতে ১২ নম্বর মূল গার্ডারটি ভেঙে গিয়েছিল। এছাড়া ২, ৯ ও ১৫ নম্বর গার্ডারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


ব্রিটিশ সরকার নিজ খরচে জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকো দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্প্যানের উদ্ধার কাজ শুরু করেন। ভারত ১২ নম্বর গার্ডারের অনুরূপ আরেকটি স্প্যান পুন:স্থাপন করে। ব্রিজের ১২ নম্বর গার্ডে আজো লেখা আছে সে তথ্য। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এ সেতু। ‘হার্ডিঞ্জ’ যেন এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। মু্ক্তিযুদ্ধের ক্ষত আর শত বছরের গৌরব নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছ মাথা উঁচু করে।
ব্রিজের শেষ গার্ডারে (১৫ নম্বর) এসে ফিরে তাকালাম দক্ষিণে-ব্রিজের অপর প্রান্তে। এ এক অসাধারণ মানবিক কবিতা। কঠিন ইস্পাতে নির্মিত এর প্রতিটি শব্দ যার গভীরে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ মানবিক সৌন্দর্য। শত বর্ষ আগে লেখা এ যেন এক অনবদ্য কবিতা।


মনে পড়ে গেল নজরুলের সেই কবিতাখানি..
‘কে কবি স্মরণ তুমি ক’রেছিলে আমাদেরে
আজি হতে শত বর্ষ আগে...
অনাগত আমাদের দখিন দূয়ারী
বাতায়ন খুলি তুমি হে গোপন হে স্বপ্ন-চারী
এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে
শত বর্ষ পরে যেথা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি...’

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৬
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।