ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সোনালী দিনের অপেক্ষায় ‘সাগরকন্যা’

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
সোনালী দিনের অপেক্ষায় ‘সাগরকন্যা’ ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কুয়াকাটা (পটুয়াখালী) থেকে: মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পাল্টে গেছে ‘সাগরকন্যা’র আগুনে রূপ। সূর্যি মামা বিশ্রামে গেছে একটু আগে, ফিরতে ফিরতে আগামী ভোর।

আলো-আঁধারিতে ফিনফিনে ঠাণ্ডা বাতাস, সামনে অথৈ সাগর, তীরে লোক সমাগম, রঙিন ছাতাগুলো বাতাসে নড়ছে।

এ ‘সাগর কন্যা’ ভ্রমণপিয়াসুদের প্রিয় কুয়াকাটা। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নে এর অবস্থান। ঢাকা থেকে ৩৮০
কিলোমিটার আর বরিশাল থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব ১০৮
কিলোমিটার।

১৮ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এ সৈকতে একই সঙ্গে দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত।

এতো রূপ-লাবণ্য, গুণাগুণ নিয়েও এতোদিন বিষন্ন ছিল সাগরকন্যা। দূরত্বের কষ্টে চাইলেও সবাই আসতে পারছিলেন না। তবে এবার তার বিষন্নতা ঘোচার পালা। দূরত্ব ঘোচাতে প্রস্তুত শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল নামের তিনটি সেতু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিন ছেলের নামে সদ্য নির্মিত সেতু তিনটি সৌভাগ্য বয়ে আনবে কুয়াকাটায়।

স্থানীয় কয়েকজন জানান, সুখবর পেয়েছেন তারাও। বুঝতে পারছেন, জীবনে বদল আসছে তাদের। দেশের উল্লেখযোগ্য ভালো জায়গাটিতে জন্ম বলে এবার নিজেদের আশীর্বাদপুষ্ট ভাবতে পারবেন।

ফাতরার বন (দ্বিতীয় সুন্দরবন), প্রাচীন কূপ, ৩৯ মণ ওজনের অষ্টধাতুর ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি, রাখাইন জনগোষ্ঠীর বর্ণিল পল্লী, মৎস্য ব্যবসার আলীপুর বন্দর, উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি নিয়ে মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধমন্দির, গঙ্গামতীর জঙ্গল- এসবে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা।

মনোমুগ্ধকর ইতিহাস-ঐতিহ্যের এসব উপকরণে সমৃদ্ধ দেশের অন্যতম সেরা এই পর্যটনকেন্দ্র এবার তিন সেতুর কারণে পর্যটকদের আরো বেশি আগমনে আরো বেশি জমজমজমাট হয়ে উঠবে- এ আশাবাদ স্থানীয়দের। পাশাপাশি সমৃদ্ধ হবে তাদের জীবন-জীবিকাও।

সন্ধ্যার সৈকতে দাঁড়িয়ে চানাচুর বিক্রি করছেন মো. আলম। মাথায় টুপি, দাড়িমণ্ডিত চেহারাটি অমায়িক স্নিগ্ধ হাসিমাখা। তিন সন্তানের জনক এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর আয় এখনও দৈনিক দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা। আশা করছেন, সেতুগুলো পুরোদমে চালু হলে আরও অনেক লোকজন আসবেন। তখন তার বিক্রিও বাড়বে।

বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আলম। ছোট মেয়েকে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চান না। ছোট মেয়ে ও একমাত্র ছেলেকে অনেকদূর পড়াতে চান তিনি। সেতু হলে সন্তানরা দূরে গিয়ে উচ্চশিক্ষাও নিতে পারবে বলেও আশা এ বাবার।

চানাচুর ক্রেতাদের একজন বলে ওঠেন, ‘এটাতো ঢাকার থেহে কাছে, কক্সবাজারের চাইয়াও এহানে ভিড় মনে করেন যে বেশি অইবে, খালি একবার পদ্মাসেতুটাও অইবার দেন, দ্যাখেন, ক্যামন ভিড়টা অয়’।

কুয়াকাটার মহীপুর ও আলীপুরের মাঝে সংযোগকারী ‘শেখ রাসেল সেতু’ উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের আগস্টে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সেতু পাড়ি দিয়ে দ্রুততম সময়ে পার হওয়া যায় শিববাড়িয়া নদী। তার আগেরটি ‘শেখ জামাল সেতু’। উদ্বোধন হয়নি বলে এখনো ফেরিতেই পারাপার।

ফেরিঘাটে চা দোকানে বসে গল্প করছিলেন কয়েকজন স্থানীয়। চা ব্যবসায়ী মো. মিজান জানালেন, শিগগিরই এ সেতুতে গাড়ি চলবে। হাজীপুর ও পুরনো মহীপুরের মধ্যে সংযোগ হবে এ সেতু।

সোনাতলা নদীতে ফেরির ইজারাদার জাহাঙ্গীর শিকদারের অবশ্য মনটা একটু খারাপ। বলেন, ‘এবার ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠবো’।

সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ধমকে ওঠেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইলিয়াস শিকদার। তারও ব্যবসার লোকসান হবে জানিয়ে বলেন, ‘৫০০ জন মানুষের লোকসান অইয়াও যদি অনে ৫০ লাখ মানুষের উপকার অয়, সেডাই কি বেশি দরকার না’?

আন্ধারমানিক নদীর ওপর ‘শেখ কামাল সেতু’। উদ্বোধনের অপেক্ষায় সেটিও।

এর পাশেই কলাপাড়ার নতুন হাসপাতাল রোডে পানের দোকান করছেন লক্ষণ। সেতু চালু হলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তিনিও। কিন্তু মন খারাপ না করে আগামীতে কী করবেন- সবার সঙ্গে আলাপ করছেন।

মোটরসাইকেল নিয়ে ফেরিতে দাঁড়িয়ে স্থানীয় যুবক আবু বকর। সেতু প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘সেতুগুলা একদম রেডি। উদ্বোধন হয় নাই, কিন্তু এর মধ্যে ব্যবহার হইসে। রাষ্ট্রপতি এবার কুয়াকাটা সফরে আসছেন এ সেতু দিয়া। তার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য বিবেচনা কইরা সেতু ব্যবহার করা হইসে। তার মানে সেতুতে কোনো ত্রুটি নাই। ত্রুটি থাকলেতো রাষ্ট্রপতিরে উডাইতো না’।

কাছেন রুচিতা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা জানালেন, তাদের মালিকও সেতু চালুর অপেক্ষায় আছেন। হোটেলটিকে আরও নতুন করে সাজাতে চান তিনি, যাতে বাইরের পর্যটকরা বেশি আসেন।

ঢাকা থেকে বরিশাল, এরপর বরগুনা, তারপর কুয়াকাটা। বিস্তর দূরত্ব বটে, তবে চারপাশের দৃশ্যও কম উপভোগ্য নয়। একঝাঁক বাচ্চা নিয়ে রাজহাঁসের রাজকীয় ঘোরাঘুরি, পানির কাছে বসে থাকা তিতির পাখিগুলো, রাস্তার পাশে মটরশুটির ক্ষেত, পানের বরজ, দু’পাশে গাছের সারি, অনেক পুকুর, গাড়ির পরোয়া না করে শালিকগুলোর আপনমনে রাস্তা পারাপারের সৌন্দর্যে মন-চোখ ভরে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ২১০৭ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৬
এসকেএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।