ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সিপ্পি অভিযান-৩

ধারালো শন আর ঘন বাঁশবন ঠেলে সিপ্পির পথে

রিয়াসাদ সানভি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৬
ধারালো শন আর ঘন বাঁশবন ঠেলে সিপ্পির পথে ছবি: শাফিন জাহিদ / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

[পূর্ব প্রকাশের পর]

সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙার কথা ছিলো। ভাঙলো নির্ধারিত সময়ই।

যখন সিপ্পির পথে রওয়ানা দিলাম তখন সাড়ে ছয়টা বাজে। রাতেও নাকি একদফা বৃষ্টি হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে পথ এখন সে তুলনায় শুকনো। তত কুয়াশাও নেই। তারপরও দূরের সিপ্পি চূড়া দেখা যাচ্ছে না। মেঘের চাদরে ওপাশে বসেই সে যে হাতছানি দিচ্ছে তা দিব্যি টের পাচ্ছি।

দূরে আবছা মতো দেখা যাচ্ছে হাতি পাহাড়। হাতির মতোই পাহাড়ের পৃষ্ঠদেশ ধাপে ধাপে নেমে গিয়ে এক জায়গায় শুঁড়ের মতো দেখতে জায়গার সৃষ্টি করছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে কোনো প্রাগতিহাসিক বিশাল ম্যামথ আকৃতির হাতি এখন শুঁড় বাড়িয়ে চলতে শুরু করবে।

এ পথের আরেক দেখার জিনিস টেবিল পাহাড়। গোল থালার মতো শীর্ষ দেশ নিয়ে সে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে আশপাশের অনেক পাহাড়কে ছাড়িয়ে।

আমরা সরু ফিতের মতো ট্রেইল ধরে হাঁটছি। দেখেই বোঝা যায় এই ট্রেইলে মানুষের চলাচল কম। দুই পাশের লতা-গুল্ম কোনো কোনো জায়গায় একেবারে চেপে ধরছে। চলার শুরুতে কিছুক্ষণ শীত করলেও এখন ঘামতে শুরু করেছি। গায়ের জ্যাকেট খুলে কোমরে বাঁধলাম। এই পথে বেশ কয়েকটি বড় ওঠা নামা আছে।

রনিন পাড়া থেকে সিপ্পি ট্রেইল ধীরে ধীরে আকাশমুখী হয়েছে। সিপ্পি রেঞ্জে পাহাড় চূড়া তিনটি। মূল সামিট চূড়াটি দূর থেকে চেনা গেলেও যতই কাছে আসতে থাকবেন ততই চোখে ধুলো দিতে সে লুকোচুরি খেলতে শুরু করবে অন্য চুড়াগুলোর  আড়ালে। মোট চারটি ধাপ- মানে চারটি পাহাড় অতিক্রম করে পৌঁছাতে হবে সিপ্পি চূড়ায়।

ধীরে ধীরে রোদের রেখা দেখা দিতে শুরু করেছে। পানির ভীষণ তেষ্টা পেলো। আমাদের সঙ্গে পলাশ তঞ্চঙ্গ্যা ছাড়াও আছে রনিন পাড়ার কারবারির ছেলে সিংহুম। সেই মূলত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রনিন পাড়ায় পানির প্রধান সরবরাহ পাইপটি সিপ্পি চূড়ার নীচের একটি ঝিরি থেকে এসেছে। পথের এক জায়গায় দেখা গেলো পাইপ ফেটে অঝোরে পানি পড়ছে। সেখান থেকে পানির বোতলগুলো ভরে নেওয়া হলো।

রাস্তা এখন মোটামুটি অর্ধ্বমুখী। সিংহুম জানালো এখন পুরো রাস্তাই শুধু উঠতে হবে। পথের এক জায়গায় পুরনো একটি জুমঘরে ফাঁকা জায়গায় একটু জিরিয়ে নিলাম আমরা। সকাল সাড়ে আটটা বাজে। যতই সিংহুমকে জিজ্ঞেস করি কতক্ষণ লাগবে সে শুধু হাঁটতে বলে। এর মধ্যে একবার ট্রেইল ছেড়ে অনেকখানি নীচে নেমে একটি ঝিরি ধরে এগোলাম। এরপর আবার সেই একঘেঁয়ে একটানা ওঠা।

আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। পুরো খাড়াই উঠে দেখলাম সবাই বসে আছে। নীচে অতলান্তিক খাদ। একটি রাস্তা জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ভাবলাম রাস্তা ভুল হয়েছে কিনা! সিংগুম জানালো সামনে যে ঘন শনের বন দেখা যাচ্ছে সেটির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। চোখে কি ভুল দেখছি। ওখানে কোনো রাস্তাই নেই। আসলে শনের বন আর বাঁশ কেটে আমাদের এগোতে হবে। গত কয়েকমাসে আমার জানা মতে সিপ্পিতে কোনো অভিযান হয়নি। ফলে কোনো ট্রেইল নেই। আর এ বছর এ পাহাড়ে কোনো জুমও হয়নি। ফলে জঙ্গলে একাকার অবস্থা।

মজা টের পেলাম শনের বনে ঢুকতেই। সিংহুম সবার আগে হাতের দা দিয়ে শন কেটে রাস্তা বানাচ্ছে আর আমরা এগোচ্ছি। শন ভীষণ ধারালো। ভাগ্যিস গায়ে ফুলহাতা শার্ট আছে। নইলে শরীর কেটে একাকার হতো। কিন্তু মুখ তো খোলা। শনের ধারালো আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো। পথে দেখলাম থোকা থোকা আমলকি পেকে আছে। তা মুখে পুরে কিছুটা শক্তি পেলাম। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু পেটে পড়েনি। কখনো মাথা নীচু করে, কখনো উবু হয়ে শন বনের অংশটুকু পার হয়ে এবার পেলাম বাঁশ বনে।

আমরা যেখান থেকে শন বনের ভেতরে ঢুকেছিলাম সেখান থেকে একটা চূড়া দেখা যাচ্ছিলো। সেটি পেরিয়ে সমতল অংশ। এখানে বাঁশের ব্যাপক আধিক্য। শন তাও হাঁচড়ে পাচড়ে পার হয়েছি, কিন্তু বাঁশবন কীভাবে পার হবো। ঝাঁকড়া বাঁশপাতায় পুরো জায়গা অন্ধকার। সন্ধ্যার মতো আবহ। শুধু পলাশদা আর সিংহুমকে অনুসরণ করে এগোচ্ছি। দাড়াম করে দুটো আছাড়ও খেলাম। একসময় দেখলাম আবারও উপরের দিকে উঠছি।


এই ফাঁকে সিপ্পি সম্পর্কে একটু বলে রাখি। বাংলাট্রেক ওয়েবসাইটের হিসাব অনুযায়ী সিপ্পি আরসুয়াংয়ের উচ্চতা ২ হাজার ৯শ ৩৯ ফুট। বিভিন্ন আদিবাসীদের ভাষায় এর নাম বিভিন্ন। বম জাতি একে ডাকে সিপ্পি, তঞ্চঙ্গ্যারা রামেতং , মার্মা – রামাতং, পাংখোয়া আরসুয়াং যার অর্থ আবার মোরগের ঝুঁটি। এছাড়া রামজুম নামেও একে ডাকা হয়। সিপ্পি পাড়া থেকে যে তিনটি চূড়া দেখা যায় তার দক্ষিনের চূড়াটি (বাম পাশের) সিপ্পি। মাঝেরটি আরসুয়াং।

বাংলাদেশ সময়: ০১৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৬
এএ

**  সিপ্পি অভিযান-২  রনিন পাড়ার চূড়ায় দেখা মেঘঢাকা সিপ্পি আরসুয়াং
**  সিপ্পি অভিযান-১  শীতের ঝুমবৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে পাহাড়ে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।