ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৩
দশ মাইল (দিনাজপুর)-সৈয়দপুর (নীলফামারী)-চিকলী বাজার (নীলফামারী)= ৩৪.৫০ কিমি
গা এলিয়ে মহাসড়কে নির্ভাবনায় শুয়ে থাকা খানপাঁচেক কুকুরকে যখন পাশ কাটাচ্ছি, তখন সবে সকাল ৭টা। আজকের যাত্রা শুরু করেছি দিনাজপুরের দশ মাইল থেকে।

সকাল ৬টায় বিছানা ছেড়ে সাড়ে ৬টায় বেরুবার আগেই মৌ ভাবি এই ভোরবেলাতেই নাশতা নিয়ে রেডি। মুইজ ভাইয়ের বাসা থেকে আমার যাত্রা শুরুর স্থল দশমাইল তথা গতকাল যেখানে শেষ করেছিলাম সেখানে এসে যাত্রা শুরু করতে ৭টা।

হাঁটা শুরু করতেই চোখে পড়ছিল প্রচুর হিমাগার। আজ এদিকটা বেশ কুয়াশাচ্ছন্ন। রাস্তাগুলোকে দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল টানেল। টানেলের শেষমাথা থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা বেরিয়ে আসছে আর সেই আলোতে হেডলাইট জ্বালিয়ে আসা বাস-ট্রাকগুলো তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।  

এদিকের রাস্তায় বিআরটিসির বাস চলে প্রচুর। রাস্তার ডানের ইক্ষু ক্ষেত দেখতে দেখতে চলে এলাম দিনাজপুর টেক্সটাইল মিলসের বিশাল এলাকায়। রাস্তার দু'পাশ জুড়েই এর বিস্তৃতি। রামডুবি মোড়ে আসতেই চোখে পড়লো জাল ঘেরা এক স্থানে প্রচুর হাঁস। প্যাক প্যাক শব্দে সরগরম জায়গাটা। খানিক পরেই কাহারোল উপজেলার সীমানা শেষ হয়ে গেলো। ঢুকে পড়লাম দিনাজপুর সদর উপজেলায়। ব্যাংকালী বাজারের সঙ্গেই একটি স্কুল, নাম সুন্দরবন প্রাথমিক বিদ্যালয়।
আত্রাই নদী, ছবি: বাংলানিউজনতুন ভূষির বন্দর থেকে খানিক এগিয়েই আত্রাই নদী। বিশাল সব চর পড়ে গেছে নদীর বুকজুড়ে। নদীর এপাড়ে সদর উপজেলা শেষ, ওপাড়ে চিরির বন্দর উপজেলা। আত্রাই নদীর উপরের সেতু পেরুতেই কৌতূহলী একদল বাচ্চার সঙ্গে দেখা। দলবেঁধে ওরা ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে পাশের পাড়ায়। প্রিয়দল, প্রিয় ক্রিকেটার এসব নিয়ে গল্প করতে করতেই চলে এলাম পুরাতন ভূষির বন্দর। বাজার পেরিয়ে অল্প এগোতেই এক ছাপড়া দোকানের দোকানি নাম-ঠিকুজি জিজ্ঞেস করতে করতে দু'কাপ চা পান করালেন। রানির বন্দর বাজার ছাড়িয়ে যেতেই হাইওয়ে পুলিশের একটা গাড়ি ঘিরে বেশ কোলাহল। একগাদা পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে ধুপধাপ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার তার কেটে দিল। এই মহাসড়কে সম্ভবত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিষিদ্ধ। ছলছল চোখে কাঁটাতারের দিকে চালকদের দৃষ্টি চোখ এড়ালো না।

আরও পড়ুন>>> পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এইদিকের মোটামুটি সব বাজারের নামের শেষেই আছে বন্দর। দেশের আর কোনো জায়গায় এত বন্দর আছে কিনা কে জানে। বেকিপুল, চম্পাতলী হয়ে ফতেজংপুরের কাছেই পড়ল বিশাল এক কারখানা। শ্রমিকদের ভিড় আশপাশের এলাকাজুড়ে। পাশেই উচ্চৈঃস্বরে গান বাজনা শুনে সেদিকে চোখ ফেরাতেই দেখলাম রক্তদান শিবির চলছে। এরকম গান বাজিয়ে রক্তদান শিবির এবারই প্রথম দেখলাম।

আজকের রাস্তায় ছায়া কম। তাও অল্প যে ক'টা গাছ আছে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউক্যালিপটাস গাছ। সোনাপুকুর নামক বাজারে এসে ঢুকে পড়লাম পার্বতীপুর উপজেলায়। রাবেয়া বাসস্ট্যান্ড পেছনে ফেলে কুন্দল থেকে শুরু নীলফামারী জেলা। দুই জেলাকে পৃথক করেছে খড়খড়িয়া নামে একটি নদী। ফোনে কথা বলছিলাম দেখে বেশ কিছুক্ষণ ম্যাপে চোখ রাখা হয়নি। এর মাশুল দিতে হলো একটু পর। সৈয়দপুরের মূল শহরের রাস্তা না ধরে আমি বাইপাস রোড ধরে নিয়েছিলাম। প্রায় কিলোমিটার দুয়েক এগিয়ে ম্যাপে চোখ পড়তেই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। ওই দুই কিলোমিটার ওই তীব্র রোদে চরম পরীক্ষা নিল।
গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোদের উকি, ছবি: বাংলানিউজ
আকাশে উড়োজাহাজ এত নিচু দিয়ে উড়ে যেতে দেখে ধরে নিলাম সৈয়দপুর সন্নিকটে। মূল শহরে ঢুকতেই পড়ল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দেশের অন্য জায়গার স্বাস্থ্য কম্প্লেক্সগুলো যেখানে অধিকাংশই পঞ্চাশ বেডের, সেখানে এই হাসপাতাল ১০০ বেড বিশিষ্ট। এক মসজিদের পাশেই অপেক্ষারত ছিলেন সাজিদ ভাই। উনি ধরে নিয়ে গিয়ে লাচ্ছি খাওয়ালেন। তার ধারণা ছিল, এখানেই আজকের মতো আমার যাত্রার পরিসমাপ্তি। সৈয়দপুর ছাড়িয়ে আরো কিছুদূর এগোনোর পরিকল্পনা শুনে উনিই বললেন চিকলী বাজার পর্যন্ত যেতে। ওখানে হাঁটা শেষ করে ফোন দিতে বললেন। উনিই ওখান থেকে আবার সৈয়দপুর নিয়ে আসবেন।

আবার হাঁটা শুরু করতেই সৈয়দপুরের বিশালতা দেখছিলাম। একে উপজেলা শহর মানতেই কষ্ট হচ্ছিল। এমাথা থেকে ওমাথা কমসে কম তিন কি. মি.। মূল শহর পেরিয়ে বাঙ্গালীপুর নামক জায়গা পেরিয়ে হাতের ডান দিকের একটা রাস্তা ঢুকে গেছে পার্বতীপুর উপজেলার দিকে। আর কামারপুকুরে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশাল ভবন পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আইসঢাল নামক জায়গায়। আর খানিকটা এগিয়েই চিকলীবাজার। এখানেই আজকের মতো যখন শেষ পদক্ষেপটা ফেললাম, মোবাইলের অ্যা জানান দিচ্ছে আজ পাড়ি দিয়েছি সাড়ে ৩৪ কিলোমিটার পথ। এখানেই আছে চিকলী সেতু।  

সেতুর ওপারেই শুরু রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা। কাল শুরু করবো এখান থেকেই। সেতুলাগোয়া একটা টংয়ের চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফোন দিলাম সাজিদ ভাইকে৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই উনি আসতেই বাইকে চেপে সৈয়দপুরের দিকে যাত্রা। আজ সাজিদ ভাইয়ের সৈয়দপুরের বাড়িতেই থাকা হবে। যে রাস্তা আমি দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে হেঁটে এসেছি, সে রাস্তা দিয়ে ফিরতে সময় লাগল পাক্কা ৯ মিনিট!

সৈয়দপুর শহরে আসতেই দেখা হলো সাজিদ ভাইয়ের বন্ধুদের সঙ্গে। মামুন ভাই, আব্দুল্লাহ ভাই সবাই দিলখোলা মানুষ। ওনারা সবাই ব্লাড ডোনেট ফাউন্ডেশন নামক গ্রুপের মেম্বার। চা-পুরির ফাঁকে ফাঁকে গল্প হলো অনেক। সৈয়দপুর শহরে বাংলার পাশাপাশি সব জায়গায় উর্দু চলে। মোটামুটি সবাই দুই ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাতাসে কাবাবের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে সাজিদ ভাইয়ের বাড়িতে আসতেই পরিচয় হলো শুভ ভাইয়ের সঙ্গে। সম্পর্কে সাজিদ ভাইয়ের ভাতিজা উনি। চাকরি করেন কক্সবাজারের উখিয়ায়। কথায় কথায় বেরিয়ে এলউখিয়ার গরুবাজারে যে বিল্ডিংয়ে উনি থাকেন, সেই বিল্ডিংয়ে আমার নিত্য আনাগোনা ছিল।

আরও পড়ুন>>> পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

গল্পের ঝুলি খুলে বসলাম দু’জন। একটু পরে সাজিদ ভাইয়ের বাইকে চেপে তিনজনে খেতে গেলাম খোরাক নামক রেস্তোরাঁয়। তারপর ঐতিহ্যবাহী চিনি মসজিদ হয়ে যখন বাড়ি ফিরছি, সৈয়দপুরের আকাশ তখন ছেয়ে গেছে দীপাবলির আতশবাজির রোশনাইতে। এক জায়গায় থেমে কিছুক্ষণ সেটাই উপভোগ করে বাড়ি ফিরে তখনো কানে বাজছে বাজারে এক বুড়োর মুখে শোনা- 'জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়'।

চলবে...

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।