পাগলামি শব্দটির আক্ষরিক অর্থ যাই হোক না কেন এর তাৎপর্য ব্যক্তি ও পরিস্থিতিভেদে ভিন্ন। একজন ধর্মপ্রচারকের চোখে দুনিয়াদারির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত মানুষ পাগল আবার তাদের চোখে ধর্মপ্রচারক নিজেই পাগল! বেশিরভাগ মানুষ যে পথে হাঁটে ও যে পথ সব অর্থেই নিরাপদ তার ব্যতিক্রম কিছু করাই পাগলামি।
আমি মাত্রই এমন একটা ভয়ঙ্কর পাগলামি সফলভাবে শেষ করে আসলাম। দুই দিন পায়ে হেঁটে জার্মান আল্পস পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু চূড়া সুগস্পিৎসে (Zugspitze) আরোহণ করেছি! মূল গল্পে যাবার আগে বলে নেই কেন এটা পাগলামি। অনেকেই তো যাচ্ছে, আর এটা তো মাউন্ট এভারেস্ট না, এমন আদিখ্যেতা দেখানোর কী দরকার?
সুগস্পিৎসেতে আরোহণকালের সরঞ্জামাদি
কারণ, আমার মতো অতি সাধারণ একজন এমন দুঃসাহস দেখিয়েছে! সুগস্পিৎসের উচ্চতা সমুদ্রসমতল থেকে ৯৭১৮ ফুট। পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতগুলোর অংশ না হয়েও এটা বিখ্যাত এর ভিন্ন ভিন্ন কঠিন রুটের কারণে! পর্বতারোহণের নিয়মকানুন আছে, আছে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ, সরঞ্জামাদি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক সক্ষমতা। এগুলোর কোনোটাই আমার নেই। ভাত খেয়ে খেয়ে মাশাল্লাহ নাদুস নুদুস শরীর। তার ওপর ২ সপ্তাহ আগে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে এক প্রকার ‘মাজুর’, হাঁটু ভাঁজ করতে পারি না, চেয়ারে বসে নামাজ পড়তে হয়। পর্বতারোহণ কোনো পার্কে হাঁটা না যে, গিয়ে আধা ঘণ্টা হেঁটে চলে এলাম। এর জন্য আপনাকে জাগতিক সমস্যা ও দুশ্চিন্তা পিছনে ফেলে যেতে হবে এবং প্রত্যেকটা স্টেপ দেখে দেখে ফেলতে হবে। একটু অন্যমনস্ক হলে আপনি সব সমস্যার ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন!
ছোট্ট রঙিন শহর গার্মিস-পার্টেনকিরসেন
দুই জন সফরসঙ্গী আনোয়ার ও আরিফ ভাইকে নিয়ে যাত্রা। জার্মানির দক্ষিণে বাভারিয়া রাজ্যের ছোট্ট একটা শহর গার্মিস-পার্টেনকিরসেন। শীতের সময় স্কি-প্রেমীদের জন্য এটা আবশ্যক গন্তব্য। ১৯৩৬ সালে নাৎসি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত জার্মানিতে শীতকালীন অলিম্পিক হয়েছিল এই শহরে, যার উদ্বোধন করেছিলেন খোদ এডলফ হিটলার। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি স্কি স্টেডিয়াম আজো সেটার স্মারক। এই শহরকে দেখে আমার হাইডেলবার্গ প্রেম একটু পাতলা হয়ে গিয়েছে! আর কেনই বা হবে না? ছোট্ট এই শহরের চারপাশে অনেক উঁচু পাহাড়। শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো দিকে আপনি চোখ তুললেই দেখবেন অপূর্ব সুন্দর পাহাড়। তীব্র খরস্রোতা পার্টনাক নদী শহরের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে গিয়েছে। সবচেয়ে অসাধারণ যে ব্যাপারটি এই শহরের তা হলো— প্রত্যেকটা ঘরবাড়ি মনে হয় একেকটা ফুলের শোরুম! ঘরের সামনে, ঘরের বারান্দায় সব জায়গায় ফুল আর ফুল! বেশিরভাগ ঘরবাড়ি কাঠের, বাভারিয়ান স্টাইলে বানানো, রঙিন। পরিষ্কার-পরিছন্ন, ঝকঝকে ও নিরিবিলি এই শহর প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ার মতো!
স্কি-রিসোর্ট
পর্বতারোহণের আগের দিন বিকেলের মধ্যে আমরা সেখানে গিয়ে একত্রিত হই। স্কি স্টেডিয়ামের পাশেই আমাদের অ্যাথলেট হোস্টেলে থাকার বন্দোবস্ত ছিল। ছিমছাম সুন্দর হোস্টেল। বিভিন্ন দেশের পর্বতারোহীরা এখানে জমায়েত হয়েছে। বিকেলে একটু হাঁটাহাঁটি ও অদূরেই আইবসি (eibsee) লেক পরিদর্শন শেষে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া, কারণ পরের দিন শুরু হতে যাচ্ছে আমাদের জীবনের এ যাবৎকালের সবচেয়ে কঠিন অ্যাডভেঞ্চার!
দৃষ্টিনন্দন আইবসি লেক
ভোর চারটায় উঠে, ফ্রেশ হয়ে, ফজর নামাজ পড়ে হালকা নাস্তা করে যখন আমরা হাঁটা শুরু করি তখন দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এত সকালে রওয়ানা হবার কারণ সূর্য উঠে গেলে হাঁটা কঠিন হয়ে যায়, ঠাণ্ডা আরামদায়ক আবহাওয়ায় কম পরিশ্রমে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা যায়। আজকে আমাদের গন্তব্য ১৯ কিলোমিটার দূরত্বে ৭০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কাঠের তৈরি কনরহুটে (knorr-hutte), যা আমাদের দেশের চিৎ-কাইত হোটেলের মতো। প্রথম ২ ঘণ্টা অনেক চড়াই, কিন্তু তরতাজা চনমনে শরীর-মন তাই খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাহাড় জঙ্গলের ভিতর দিয়া হেঁটে চলা! বার্চ ও পাইন গাছের সমারোহ, পাহাড়ি নদী ও ঝর্নার তীব্র শব্দ, পাখির কিচিরমিচির— সব মিলে দুর্দান্ত উপভোগ্য ছিল প্রথম ৮ ঘণ্টার হাঁটা। তখনো কল্পনা করিনি সামনে আমাদের জন্য কী ভয়ঙ্কর সময় অপেক্ষা করছে!
৭০০০ ফুট উচ্চতায় প্রথম দিনের বিশ্রামাগার
খাবার জন্য আমাদের সাথে ছিল ইনস্ট্যান্ট কাপ নুডলস, চকলেট ও আপেল। নুডলস আর কফি খাবার জন্য লাগবে গরম পানি তাই সাথে করে ছোট্ট পোর্টেবল চুলা ও পাতিল নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম ৮ ঘণ্টায় আমরা সর্বমোট ৩টা ব্রেক নেই। ৮ ঘণ্টা হাঁটার পর শুরু হয় খাড়া পাহাড়ে আরোহণ। প্রথমদিকে কম উচ্চতার পাহাড়গুলি ছিল গাছপালা ও ঘন অরণ্যে বেষ্টিত। আস্তে আস্তে পাহাড়গুলো পাথুরে ও রুক্ষ হতে শুরু করে। উল্লেখ্য যে, সুগস্পিৎসে-তে ক্যাবল কারে চড়ে যাওয়া যায় এবং প্রতিদিন হাজার হাজার টুরিস্ট সেখানে যাচ্ছেন, কিন্তু হাইকিং করে গেলে আপনি প্রকৃতির চেহারা ও বৈচিত্র্যের যে অপূর্ব পরিবর্তন দেখবেন তার কোনো তুলনা নেই!
প্রথমদিকে কম উচ্চতার পাহাড়গুলি ছিল গাছপালা ও ঘন অরণ্যে বেষ্টিত
গাছপালার অঞ্চল ছাড়িয়ে যখনি আমরা রুক্ষ ও খাড়া অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হই তখন থেকেই শুরু হয় বিপত্তি! এতক্ষণ আমাদের ৩ জনের হাঁটার গতি ছিল প্রায় সমান, কিন্তু এখন আমি সবার পিছনে এবং কিছুক্ষণ পর আমার সফরসঙ্গীরা দৃষ্টিসীমার বাইরে! আমি ১৫-২০ পা অগ্রসর হয়ে ১ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে যাই, মনে হচ্ছে বুকের ভেতর ড্রাম বাজছে, ফুসফুসের এতই প্রেসার যে মনে হচ্ছিল সেটা গলা দিয়ে বের হয়ে আসবে! দুই-তিনবার রাস্তা ভুল হবারও উপক্রম হয়েছিল। আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন অংশ ছিল দিনের শেষভাগে প্রায় ১১ ঘণ্টা হাঁটার পর যখন আমাদের প্রথম রাতে থাকার জায়গা মাত্র ১ ঘণ্টা দূরত্বে তখন পাহাড় এতই খাড়া আর বিপজ্জনক ছিল যে, মারাত্মক ভয় পেয়ে যাই! পায়ের জুতা ঠিকমতো গ্রিপ করছিল না, ঘাম কপাল বেয়ে চোখে ঢুকে যাচ্ছে আর প্রচণ্ড চোখ জ্বালাপোড়া করছে— সাথে এক ফোঁটা পানি নেই, গলা শুকিয়ে কাঠ! একটু পর পর মনে হচ্ছিল এই বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাব! সেখানে যদি একবার নিয়ন্ত্রণ হারাই তাহলে মুহূর্তে হাজার ফুট নিচে নেমে যাব। সোজা আল্লাহর দরবারে! যত দোয়া জানা ছিল সব পড়ে ফেলেছি, নিজের ভুল আর গুনাহের জন্য মাফ চেয়ে এক পা এক পা করে আগানোর চেষ্টা করছি…
সুগস্পিৎসের চূড়ায় লেখক
কত অভাব অভিযোগ আমাদের জীবনে, পাওয়া না পাওয়ার কত হিসাব-নিকাশ। পড়াশোনা-চাকরি-ক্যারিয়ার, অর্থবিত্ত-ক্ষমতা ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে হিসাব-নিকাশ, প্রতিযোগিতা, লড়াই, অশান্তি…
শুধু বেঁচে থাকাটাই যে কত বড় নেয়ামত আজকের আগে এমন করে আর কখনো বুঝিনি! (চলবে)
আবুল হাসান
হেইডেলবার্গ, জার্মানি
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০২০
এমজেএফ