বলকান উপদ্বীপের ছোট্ট এক স্বাধীন দেশ কসোভো (Republic of Kosovo)। উচ্চারণ জটিলতায় অনেকেই কসোভা বলে থাকেন।
এরপরও বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে কসোভোর মানুষ তাদের ঈমান ও ইসলাম টিকিয়ে রেখেছে। ইউরোপের ইসলাম বিদ্বেষী শক্তিগুলোর আক্রমণের শিকার হয়েছে অত্র অঞ্চলের মুসলিম জনগণ। সবশেষ নব্বইয়ের দশকে হানাদার সার্ব বাহিনীর হাতে লাখ লাখ মুসলিম প্রাণ হারায় এবং গৃহহারা হয় অসংখ্য মানুষ।
অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এখন কসোভো একটি মুসলিম রাষ্ট্র। কসোভোর জনগণের প্রায় ৯৫ ভাগই মুসলিম। মুসলমানদের অধিকাংশই রোজা রাখেন এবং ধর্মকর্ম পালনে তারা বেশ নিষ্ঠাবান। সে হিসেবে বলা যায়, কসোভোয় রোজা রাখে প্রায় শতভাগ মানুষ!
কসোভোর প্রতিটি জেলায় রয়েছে একটি ইসলামিক সেন্টার ও পাঁচটি ধর্মীয় স্কুল। যেখানে শিক্ষার্থীদের ইসলাম ও আরবি ভাষা-সাহিত্য শেখানো হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে মনোযোগ দিয়েছে তারা। সার্বদের হাতে ধ্বংস হওয়া ইসলামি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এবং ধর্মীয় অবকাঠামোর পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করেছে। কসোভোর দুই শতাধিক মসজিদ ধ্বংস করে সার্ব বাহিনী। কসোভোর ধর্মবিদ্বেষী কমিউনিস্ট শাসকরা বিগত ৭০ বছর ধরে ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সকল প্রকার ধর্মীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে রাখে।
তারা অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। কসোভোর মুসলিমরা চেষ্টা করছে ইসলামের হারানো ঐতিহ্য ও আবহ ফিরিয়ে আনতে। তারা নতুনভাবে মসজিদ-মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। বর্তমানে মাদরাসায়ে আলাউদ্দিন নামে একটি প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে এবং একটি বিশেষায়িত ইসলামিক কলেজ চালু হয়েছে।
কসোভোর পুনর্গঠনে সে দেশের জনগণ ধনী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাহায্য প্রত্যাশা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া ব্যতীত অন্য কোনো মুসলিম দেশ এগিয়ে আসেনি। তবে বিভিন্ন দেশের কিছু বেসরকারি সাহায্য প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দানশীল মানুষের উদ্যোগে গঠিত ‘আলমাশিখাতুল ইসলামিয়া’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা সেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও ইসলামি শিক্ষার বিস্তারে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে, তারা ২৪টি ইসলামি শিক্ষা ও প্রচার কেন্দ্র এবং ৫৫০টি মসজিদ নির্মাণকরেছে। তাদের অধীনে ৫০০ আলেম ও মুবাল্লিগ কসোভোয় ইসলাম প্রচারের কাজ করছে।
রমজানের চাঁদের ব্যাপারে কসোভোর মুসলিমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনুসরণ করে। সেই সঙ্গে তুরস্ক ও ইউরোপীয় ফতোয়া ও গবেষণা বোর্ডের পরামর্শ গ্রহণ করে। রমজানের আগমনে কসোভোর মুসলিমরা আনন্দে মেতে ওঠে এবং রঙিন ফানুস নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। ছোট বড় সবাই পরস্পরকে অভিনন্দন জানায়।
রমজানের কয়েকদিন পূর্ব থেকে তারা মসজিদগুলোকে মুসল্লিদের জন্য প্রস্তুত করে। স্বাধীনতার পর থেকে কসোভোর মুসলিমরা রমজান মাসে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে সম্মিলিত দোয়ার আয়োজন করে। প্রতিটি মসজিদে বিতর ও ফজরের নামাজে ‘কুনুতে নাজেলা’ পড়া হয়।
রমজানে কসোভোর মুসলিমরা কোরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ নামাজ, অধিক পরিমাণে সালাতুত তাসবিহ আদায় অন্যান্য ধর্মীয় জ্ঞান আহরণ করে কাটাতে পছন্দ করে। জোহরের পর মসজিদে মসজিদে ইসলামি বিশ্বাস ও বিধি-বিধানের দরস হয়। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত হয় কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়ার অনুষ্ঠান। সাধারণ মুসলিমরা তাতে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করে।
কসোভোর মুসলিমরা রমজান মাসটি পারিবারের সঙ্গেই কাটাতে পছন্দ করে। ইফতার ও সেহরি অবশ্যই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে করে। এশার নামাজের পর পরিবারে সব সদস্য একত্র হয়ে খোশগল্পে মত্ত হয়। এ সময় পরিবারের বয়োজৈষ্ঠ্য সদস্য তাদের পরিবারের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের কথা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেন। পারিবারিক এই বৈঠকে হরেক রকম ফলের জুস পরিবেশন করা হয়। সবচেয়ে বেশি পরিবেশন করা হয় আপেলের জুস। কখনো কখনো এ আড্ডা সেহরি পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। ইফতারের সময় হলে তারা ফলের জুস বা পানীয় ও খেজুর দ্বারা ইফতার করে। তারপর মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করার পর ঘরে ফিরে ইফতার করে। ইফতারে কসোভোবাসীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হলো- ‘বুরিক। ’ গরুর গোশতের কিমা দিয়ে তৈরি বিশেষ খাবার।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘন্টা, জুলাই ০১, ২০১৫
এমএ/