ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

ব্রিটেনের মুসলমানরা আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে পালন করছেন ১৯ ঘণ্টা রোজা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০১৬
ব্রিটেনের মুসলমানরা আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে পালন করছেন ১৯ ঘণ্টা রোজা

পশ্চিমা সভ্যতার পীঠস্থান, স্বপ্নের দেশ, রাণীর দেশ ব্রিটেন। এককালে আমরা যাদের উপনিবেশ ছিলাম- সেই ব্রিটেন একসময় অর্ধ বিশ্ব শাসন করত।

শক্তিধর দেশটিতে সহিষ্ণুতা আর সম্মানের সওগাত নিয়ে আসে কোরআন নাজিলের মাস রমজান।

পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশের বহু মুসলমানের বসবাস এই ব্রিটেনে। ইউরোপের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয় ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনকে। এ শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৮৫ লাখ। মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ, যা গোটা জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ।

তাজমহলের আদলে তৈরি গম্বুজ ও মিনারবিশিষ্ট ইস্ট লন্ডন মসজিদে জুমা, ঈদ ও তারাবির নামাজে হাজার হাজার মানুষের ঢল দেখে ব্রিটেনে তাকওয়াভিত্তিক সমাজের প্রতি গভীর অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। লন্ডনের মেয়র হিসেবে নবনির্বাচিত সাদিক খান এবং ক্যামডেন শহরের মেয়র বাংলাদেশি নাদিয়া শাহ’র বিজয় আমাদের এই ধারণাকে অসার হতে দেয় না।
 
পাশ্চাত্যের যেসব দেশে ইসলামের বিস্তার বা জাগরণ চোখে পড়ার মতো- সেসব দেশের মধ্যে ব্রিটেন অন্যতম। শুধু টাওয়ার হ্যামলেটসে মসজিদের সংখ্যা হচ্ছে ৪০-এরও বেশি। প্রতিটি গলিতে একটি করে মসজিদ। জোহর বা আসরের নামাজের সময় আপনি যদি হোয়াইট চ্যাপেল হাইরোড দিয়ে হাঁটেন, তখন একাধিক মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি শুনতে পাবেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের বাইরে বেশি মুসলমান বাস করেন নিউহাম ও রেডব্রিজ বারাতে। যুক্তরাজ্যে মসজিদের সংখ্যা ১৬শ’ এর অধিক। লন্ডনে মসজিদের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় চার শ’র মতো। নামকরা মসজিদগুলোর মধ্যে হচ্ছে, আরবদের তৈরি রিজেন্ট পার্ক মসজিদ এবং হ্যকনি বারাতে তুর্কিদের তৈরি সোলায়মানিয়া মসজিদ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ১৯৯৬ সালে সর্বপ্রথম ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন হোয়াইট হাউজে। এর পর থেকে প্রতি বছরই মুসলমানদের জন্য ইফতার মাহফিল হয়ে আসছে হোয়াইট হাউজে। ব্রিটেনেও সরকারিভাবে রমজানকে খোশ আমদেদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি প্রদান করেন এবং ঈদের শুভেচ্ছা জানান।

ব্রিটেনে ঈদুল আজহা থেকে বেশি পরিচিত ঈদুল ফিতর এবং রমজান মাস। অমুসলিমরাও এই রমজান সম্পর্কে পরিচিত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়-সব জায়গায় বিভিন্ন ধর্মের লোকের সঙ্গে মুসলমানদের চলাফেরা। তাই তারা রমজান সম্পর্কে বেশ ভালো অবগত। লন্ডনে বড় বড়  সুপারশপে মেরি ক্রিশমাসের মতো আলাদা সেকশন রাখা হয় রমজান উপলক্ষে এবং সেখানে বড় বড় ব্যানারে লেখা থাকে ‘RAMADAN MUBARAK’। বিভিন্ন ধরনের খাবার যেমন, খেজুর, ছোলার ডাল, বুটের ডাল, জুস, সেমাই, কিসমিস, বেসন, ঘি একসাথে রাখা হয় রোজাদারদের সুবিধার জন্য।

ইফতারিতে ব্রিটিশ রোজাদাররা খেজুর, ফল, স্যুপ, জুস, রুটি, ডিম, মাংস, চা-কফি ইত্যাদি থাকে। ব্যস্ত শহরে প্রবাসীদের রোজা রোখে কর্মস্থলে যেতে হয় জীবিকার তাগিদে। তবে কাজের জায়গায় বিদেশি কলিগরা বেশ সাহায্য সহযোগিতা করে থাকেন। ইসলাম যে সার্বজনীন এবং মাহে রমজান সত্যিই যে তাকওয়ার মাস, এটি তার একটা প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

ইউরোপের অনেক দেশের মতো লন্ডনে বেশ দীর্ঘ সময় রোজা রাখতে হয় মুসলমানদের। তাই গত রমজান মাসের শুরুতে দেশটিতে একটা বিতর্ক শুরু হয়েছিল বেশ তিক্ত ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই। সেখানে রোজা রাখতে হয় প্রায় ১৯ ঘণ্টা। এটা বেশি কঠিন ব্যাপার, বিশেষ করে কর্মজীবীদের জন্য। এ কারণে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো সংস্থা কুইলিয়াম ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ রমজানের সময়সূচি কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কুইলিয়াম ফাউন্ডেশনের একজন আলেম ড. ওসামা হাসান বলেছিলেন, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা রাখার অর্থ হচ্ছে কোনো ধরনের খাবার বা পানি ছাড়াই প্রায় ১৯ ঘণ্টা কাটানো। ব্রিটেনে রোজা রাখার এই সময় মধ্যপ্রাচ্য বা বিশ্বের যেকোনো মুসলিম দেশে রোজা রাখার সময়ের তুলনায় বেশি। তিনি বলছেন, এ কারণে রোজা রাখার সময়ে পরিবর্তন আনার মধ্যে যৌক্তিকতা আছে। তার মতে, এই সময় কয়েক ঘণ্টা কমিয়ে আনা যেতে পারে। ড. হাসান বলছেন, ‘মক্কায় যেমন ১২/১৩/১৪ ঘণ্টা রোজা রাখা হয়; সে রকম রাখলেই হয়। এরচে বেশি সময় রোজা রাখার দরকার নেই। ’

কিন্তু দেশটির বলতে গেলে কেউ সেই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। বৃটিশ মুসলমানরা মনে করেন, তারা যেদেশে বসবাস করছেন সেদেশে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় অনুসরণ করেই তাদেরকে রোজা রাখতে হবে। তাদের যুক্তি হলো, যতক্ষণ ধরেই রোজা রাখা হোক না কেন- এক সময় মানুষের শরীর এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কেউ কেউ বলেন, এ জন্যে আল্লাহও তাদেরকে সাহায্য করেন।

লন্ডন শহরের  প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ইস্ট লন্ডন মসজিদ ইউরোপ তথা লন্ডনের বড় মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে রমজান মাসজুড়ে চলে নানা ইসলামিক অনুষ্ঠান। এখানে ফিতরা, জাকাতের অর্থ সংগ্রহ করা হয় গরিব-দুঃখির জন্য। তারাবির নামাজের সময় দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে চড়ে, গাড়িতে করে এবং বাসে চড়ে হাজার হাজার মানুষ তারাবির নামাজ পড়তে আসেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাদা, কালো, এশিয়ানসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর, বিভিন্ন আয়ের ও বয়সের লোক। তাদের বেশিরভাগই যুবক। তারাবির নামাজ শেষ হলে মনে হয়, মানুষ যেন উৎসব শেষে বাড়ি ফিরছে।

ব্রিটিশ মুসলিম সমাজে বিশ লাখেরও বেশি জনগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে বাঙালীদের রয়েছে সরব অংগ্রহণ, এমনকি নেতৃত্বও দিচ্ছেন অনেক বাংলাদেশি। তাই অন্যান্য দেশের তুলনায় সেখানকার খাদ্যাভ্যাস বাংলাদেশিদের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। এ কারণে ব্রিটেনের ইসলামের রং এবং স্বরূপ অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার বেশিরভাগ মুসলমানই হানাফি মাজহাবের অনুসারী।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১০ ঘণ্টা, জুন ০৯, ২০১৬
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।