ঢাকা: অত্যন্ত বরকতময় মাস পবিত্র মাহে রমজান। এ মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নামাজ, রোজা, কোরআন তেলাওয়াতসহ বিভিন্ন ধরনের ইবাদাত-বন্দেগির মধ্যে দিয়ে সময় পার করেন।
সেহেরি ছিল লোভনীয়
আমাদের শহরে সাইরেন বাজত। সাইরেন বাজিয়ে সেহেরির সময়টা জানানো হত। এছাড়া একজন অবাঙালি ফকির ধরনের মানুষ ছিলেন, তিনি চিৎকার করে বলতেন, রোজাদার ওঠো, জাগো, সেহেরির সময় হয়েছে। তারপর বড়রা উঠতেন। সেহেরির জন্য গরম ভাত, ডাল, দুধ, কলা, চিড়া প্রস্তুত করতেন। আমাদের কাছে তখন ভোরে উঠে সেহেরি খাওয়াটা লোভনীয় ব্যাপার ছিল।
দিনে ৩টা রোজ রাখতাম
পুরো দিন রোজা রাখার জন্য ওই সময় অভ্যস্ত ছিলাম না। আমার বাবা এ ব্যাপারে জোর করতেন না। মাও ছিলেন লিবারেল। দাদিও চাপ দিতেন না। ফলে বড়দের সঙ্গে প্রতিদিন সেহেরি খেলেও দিনে ৩টা রোজা রাখতাম। বড়দের বলতাম আমি ৩টা রোজা রেখেছি। পুরো মাসে হিসাব হত মোট ক’টা রোজা হলো আমার।
ইফতার ছিল আনন্দের
ইফতারের আগেই আমরা সবাই তৈরি হয়ে যেতাম। বড়রা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ইফতার তৈরিতে। সে সময় এত ভ্যারাইটিস ধরনের ইফতার আইটেম চিন্তাই করা যেত না। ইফতার বেঁচাকেনার সংস্কৃতি একেবারেই ছিল না। সবই ঘরে তৈরি হত। আমার ছোটবেলায় রোজা আসত শীতের সময়। ফলে প্রচুর কমলা পাওয়া যেত। ইফতারের মেন্যুতে থাকত রসালো সুস্বাদু কমলা। বাবা চিড়া পছন্দ করতেন। দেশজ ফল-মূল ছিল ইফতারের মূল আকর্ষণ। ইফতারের সময়টা ছিল সবচেয়ে আনন্দের।
স্কুল জীবন থেকে রোজা রাখা শুরু
বাল্যকালে রোজার ব্যাপারটা ছিল অন্য আর দশটি শিশুর মতোই। পরবর্তীকালে স্কুলে পড়ার সময় রোজা রাখার চেষ্টা করেছি। সব রোজা রাখতে পারতাম না। ভেঙে ভেঙে দুইটা-চারটা করে রোজা রাখতাম। তবে এইট নাইনে উঠে রোজা রাখার বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছি। যদিও বাবা-মা‘র পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো চাপ ছিল না। বাবা ছিলেন মুসলিম লীগার। কিন্তু রোজার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করেননি। যা বলার মা বলতেন। মাও খুব একটা চাপ সৃষ্টি করেননি। মাকে আমরা কখনই বোরকা পরতে দেখিনি। তাকে রাইফেল হাতে ট্রেনিং নিতে দেখেছি।
কলেজে এসে রোজা বাদ হয়ে যায়
ঢাকা কলেজে পড়তে এসে রোজা একদম বাদ হয়ে যায়। আধুনিক সাহিত্য পড়া, সিনেমা দেখা ও বইপত্র পড়ার ফলে মনোজগতে বিশাল পরিবর্তন আসে। যেহেতু আমার ঝোঁকটা ছিল সমাজতন্ত্রের দিকে, সমাজ পরিবর্তনের দিকে সেহেতু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের বিষয়টি তখন গৌণ হয়ে যায়। তারপরও রোজার মাসের অর্ধেকটা সময় ছুটি থাকায় সোজা গ্রামে চলে যেতাম। পরিবারের সাথে পুরো রোজায় আনন্দময় দিন কাটত।
মুক্তিযুদ্ধের পর নামাজ রোজা আবার শুরু
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর ও সুসজ্জিত পাক হানাদারহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণ দেখে ভেতরে প্রচণ্ড রকম ধাক্কা খাই। কেবলই মনে হতে থাকে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণেই পতন হয়েছে তাদের। অর্থাৎ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করার জন্য ওপরে একজন আছেন। এই বোধ থেকেই ফের নামাজ-রোজা শুরু করি। এখনো তা অব্যাহত আছে।
রোজার মধ্যে ঈদের কেনা-কাটা
আমার বাবা বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু কোনো দিন আমাদেরকে বিলাসিতার মধ্যে দিয়ে মানুষ করেননি। আমার মনে আছে, ছোটবেলা শীতের দিন ফুল প্যান্ট পরতে হত। বাবার পুরনো প্যান্ট কেটে মা প্যান্ট বানিয়ে দিতেন। কারণ, প্রতি শীতে নতুন ফুল প্যান্ট পরব-এই বিলাসিতা আমাদের কারো মধ্যে ছিল না। বাবার পুরনো কোট কেটে মা আমাদের ওভার কোট বানিয়ে দিতেন। অপেক্ষা করতাম ঈদের আগে নতুন জামার জন্য। ঈদ এলেই পেতাম নতুন জামা। রোজার শেষের দিকে ঈদের কেনা-কাটা হত।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৬ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৬
এজেড/এমএইউ/