ঈমানদার মুসলমানরা গুরুত্বসহ রোজা পালন করে থাকেন। কিন্তু রোজা সংক্রান্ত মাসয়ালা-মাসায়েল না জানার কারণে অনেক সময় বেকায়দায় পড়তে হয়।
মাসয়ালা: রোজা অবস্থায় কোনো খাবার বস্তু রোজাদারের পেটে বা মগজে যেকোনো পথ দিয়ে সরাসরি প্রবেশ করলে রোজা ভেঙে যায়। অনুরূপ সকল প্রকারের ঔষধ, ধোঁয়া বা গ্যাস জাতীয় পদার্থ সরাসরি পেট বা মস্তিষ্কে প্রবেশ করানোর দ্বারা রোজা ভেঙে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/৯৩
মাসয়ালা: রোজা অবস্থায় কামরায় কয়েল জ্বালাবে না। রোজার কথা স্মরণ থাকাবস্থায় স্বেচ্ছায় ও নিজ কর্ম দ্বারা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কয়েলের ধোঁয়া গলায় বা মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে রোজা ভেঙে যাবে। তাই মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার একান্ত প্রয়োজন হলে অন্যপন্থা অবলম্বন করবে। -আদ দুররুল মুখতার: ২/৩৯৫, ইমদাদুল ফাতাওয়া: ২/১৩৮
মাসয়ালা: অভ্যাসগতভাবে যারা গুল ব্যবহার করে তারা রোজা অবস্থায় গুল ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে এবং কাজা ও কাফফারা আদায় করতে হবে। আর যদি অভ্যাসগত না হয় বরং দাঁতের কোনো উপকার বা দাঁত পরিষ্কারের লক্ষ্যে গুল ব্যবহার করে তাহলে গলার ভেতরে তার প্রতিক্রিয়া চলে যাওয়া নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রোজা ভাঙবে না। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/২০৪, ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া: ৪/১৭৬, ফাতাওয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৫/৪৫০
মাসয়ালা: চুলায় রান্না করার সময় নাক-মুখ দিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে ধোঁয়া প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হয় না, ইচ্ছাকৃত ধোঁয়া নাক-মুখ দিয়ে প্রবেশ করালে রোজা ভেঙে যাবে। -হেদায়া: ১/১০৮, বাদায়েউস সানায়ে: ২/৯০
মাসয়ালা: কানে ঔষধ বা তেল ঢাললে রোজা ভেঙে যাবে। তেমনিভাবে নাকে ঔষধ দিয়ে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলে রোজা ভেঙে যায়। -সহিহ বোখারি: ১/২৫৯
মাসয়ালা: ইচ্ছা করে মুখভরে বমি করলে রোজা ভেঙে যাবে। হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘কেউ বমি করলে রোজা কাজা করতে হয় না। তবে ইচ্ছা করে বমি করলে তাকে কাজা করতে হবে। ’ -মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক: ৪/২১৫, মুসতাদরাকে হাকেম: ১/৪২৭
মাসয়ালা: রোজা অবস্থায় ডুস ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যাবে। তবে পরবর্তীতে এর শুধু কাজা করা ওয়াজিব হবে। -হিদায়া: ১/২২০, ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া: ২/৩৬৫
মাসয়ালা: স্ত্রীকে চুমু দেওয়া কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে আনন্দসুলভ আচরণ করার কারণে বীর্যপাত হলে রোজা ভেঙে যাবে। এক্ষেত্রে শুধু কাজা ওয়াজিব হবে, কাফফারা ওয়াজিব হবে না। তবে ইচ্ছাকৃত সহবাস করলে কাজা ও কাফফারা উভয়টি ওয়াজিব। -রদ্দুল মুহতার: ২/১৪২
মাসয়ালা: রাত বাকি আছে মনে করে সময়ের পরে সেহরি খেলে সাঈদ ইবনে জুবায়র (রা.) বলেন, কেউ (সুবহে সাদিক হয়নি মনে করে) সুবহে সাদিকের পর কিছু খেলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে এবং অন্য একদিন তা কাজা করে নিবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/১৪৯
মাসয়ালা: সূর্য অস্ত গিয়েছে মনে করে সময়ের আগেই ইফতার করে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে। হজরত আলী ইবনে হানজালা (রহ.) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি রমজানে ওমর (রা.)-এর কাছে ছিলাম তখন তার সামনে পানীয় পেশ করা হলো। কিছু লোক সূর্য ডুবে গিয়েছে মনে করে ইফতার করে ফেললেন। এরপর মোয়াজ্জিন এসে বললেন, আমিরুল মুমিনীন! সূর্যতো এখনো অস্ত যায়নি। তখন হরজত ওমর (রা.) ঘোষণা করলেন, আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে শিরক থেকে নিষেধ করেছেন। দুই বার কিংবা তিনবার তিনি একথা বলেছেন। এরপর বললেন, যারা ইফতার করেছে তারা যেন এ দিনের পরিবর্তে অন্য একদিন রোজা রাখে। আর যারা ইফতার করেনি তারা যেন সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের রোজা পূর্ণ করে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ৬/১৫০
যে সব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় না
এমন কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো রোজাবস্থায় করার দ্বারা রোজা ভঙ্গ হয় না রোজা মাকরূহও হয় না। কিছু কিছু মানুষকে দেখা যায় এ সমস্ত কাজ করার পরে মনে করে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে। তাই খাওয়া-দাওয়া করে ফেলে। ফলে তার রোজা ভেঙে যায় এবং কাজা ওয়াজিব হয়ে যায়। সুতরাং এগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি।
মাসয়ালা: যদি রোজা অবস্থায় ভুলে কিছু খেলে, পান করলে বা স্ত্রী সঙ্গম করলে- রোজা ভাঙবে না। যদিও পেট ভরে খেয়ে থাকে। -সহিহ বুখারি: ১/২৫৯, আদদুররুল মুখতার: ৩/৩৬৫
মাসয়ালা: দিনের বেলা স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙবে না। -তিরমিজি: ১/১৫২
মাসয়ালা: রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় সুরমা লাগানো, তেল লাগানো এবং সুগন্ধিযুক্ত জিনিষ যেমন আতর, ফুল, সেন্ট ইত্যাদির ঘ্রাণ নিলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। বরং যদি সুরমার রং থুথুর সঙ্গে মুখ দিয়ে বেরও হয় তবুও রোজার ক্ষতি হবে না। -তিরমিজি: ১/১৫৪, আদ দুররুল মুখতার: ৩/৩৬৬
মাসয়ালা: রোজা অবস্থায় কন্ঠনালীর ভেতরে মশা, মাছি, ধুলা-বালি ইত্যাদি চলে যায় তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে না, চাই তা পেটের ভেতরে চলে যাক না কেন। কেননা এগুলোকে মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না। যদিও মুখে তার স্বাদ অনুভব হয়। -ফাতাওয়ায়ে কাজিখান: ১/২৯৮
মাসয়ালা: কুলি করার পর মুখের মধ্যে যে আদ্রতাভাবে থাকে তা গিলে ফেললে রোজা নষ্ট হবে না। তবে কুলি করার পরে দু’এক বার থুথু ফেলে দিতে হবে। কেননা কুলি করার পর মুখের ভিতর কিছু পানি থেকে যায়। তাই দু’ এক বার থুথু ফেলার পরে যে আদ্রতা থাকে তা গিলে ফেললে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। -আদদুররুল মুখতার: ৩/৩৬৭
মাসয়ালা: রোজার মধ্যে দাঁত পরিস্কার করার জন্য মাজন ব্যবহার করতে গিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যদি দাঁত পরিস্কার করার সময় কন্ঠনালী পর্যন্ত কিছু না পৌঁছে তাহলে কোনো অসুবিধা হবে না। তবে রোজাবস্থায় মাজন বা টুথপেষ্ট ব্যবহার করা মাকরূহ ও অনুত্তম বিধায় তা পরিহার্য। -রদ্দুল মুহতার: ৩/৩৯৫
মাসয়ালা: ডাক্তারদের মতানুযায়ী ইনজেকশন দ্বারা ঔষধ বা স্যালাইন পেটে বা মস্তিষ্কে সরাসরি প্রবেশ করে না, তাই যেকোনো প্রকার ইনজেকশন দ্বারা রোজা ভাঙবে না। তবে খাবারের চাহিদা মিটায় এমন গ্লুকোজ স্যালাইন অতি প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করলে রোজা মাকরূহ হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/৯৩, ফাতহুল কাদির: ২/২৫৭, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/২০৪, ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়া: ২/৩৮
মাসয়ালা: চোখে ড্রপ ব্যবহারের দ্বারা রোজা ভাঙে না, এমনকি চোখে ড্রপ ব্যবহারের পর মুখে ঔষধের তিক্ততা অনুভূত হলেও ভাঙবে না। -রদ্দুল মুহতার: ২/১০৬, আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৪৩৮
মাসয়ালা: রোজা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের করলে রোজা নষ্ট হয় না। তবে রক্ত বের করার দ্বারা দুর্বল হয়ে রোজা রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা হলে রক্ত বের করা মাকরূহ বলে বিবেচিত হবে। -আলবিনায়া: ৩/৬৪২, আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৪৩৫
মাসয়ালা: অনিচ্ছাকৃত বমি হলে রোজা নষ্ট হয় না, চাই মুখভরে হোক বা অল্প হোক। - সহিহ বুখারি: ১/২৬০
বাংলাদেশ সময়: ১৮০০ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০১৬
এমএইউ/