আজকের ১৪তম খতমে তারাবিতে পবিত্র কোরআনে কারিমের তেলাওয়াতকৃত অংশসমূহের বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে, আমলের ইখলাস। ইসলামের পরিভাষায়, শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ সম্পাদন করাকে ইখলাস বলে।
ইখলাস হলো, যেকোনো কাজের মূলভিত্তি। মূলভিত্তি দুর্বল হলে যেমন বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে সহজেই, ঠিক তেমনই হবে আমদের কাজের পরিণতি সেটা যদি হয় ইখলাসবিহীন। তাই ইখলাসকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চাবিকাঠি বলা চলে। এ বিষয়ে সূরায়ে হজের ৩৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের পশু কোরবানির গোশত, রক্ত কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। বরং আল্লাহর কাছে পৌঁছে থাকে তোমাদের মনের খোদাভীতি। ’
পূর্বেই বলেছি, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নেক আমল করাকে ইখলাস বলে। যে কোনো নেক আমল কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত ইখলাস। ইখলাসের বিপরীত হল রিয়া। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে, সুনাম ও সুখ্যাতির উদ্দেশ্যে কোনো আমল করাকে রিয়া বলা হয়। উক্ত আয়াতে ইখলাসের একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। কোরবানির গোশত, রক্ত আল্লাহ গ্রহণ করেন না। আল্লাহ গ্রহণ করে থাকেন কোরবানি দাতার মনের আবেগ।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের অনেক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে। যেমন-
‘বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কোরবারি, আমার জীবন, আমার মরণ একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র জগতের প্রতিপালক। ’ –সূরা আনআম: ১৬২
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘দ্বীনের কাজ ইখলাসের সঙ্গে কর। অল্প আমলই তোমার নাজাতের জন্য যথেষ্ট হবে। ’ –কানজুল উম্মাল: ৫২৫৭
‘তোমাদের আমলগুলো শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কর। কেননা, যে আমল শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য করা হয় না, আল্লাহ তা কবুল করেন না। -কানজুল উম্মাল: ৫২৫৮
‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের দেহ ও চেহারার দিকে লক্ষ্য করেন না। তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের মনের প্রতি। ’ –সহিহ মুসলিম: ৬৭০৭
‘আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি অংশীদারদের অংশস্থাপনের মুখাপেক্ষী নই। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো আমলের মধ্যে আমার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে, তবে আমি ওই ব্যক্তিকে তার শিরকের ওপর সোপর্দ করে থাকি। ’ –সহিহ মুসলিম: ৭৬৬৬
‘যখন আল্লাহতায়ালা পূববর্তী ও পরবর্তী সব আদম সন্তানকে সেদিন একত্রিত করবেন, যে দিনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, তখন একজন ঘোষক উচ্চঃস্বরে ঘোষণা দিবে, যে ব্যক্তি কোনো আমলের মধ্যে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করেছে, সে যেন তার আমলের প্রতিদান সেই শরিকের কাছে দাবি করে। কেননা, আল্লাহতায়ালা শরিকদের অংশ থেকে মুক্ত। ’ -মুসনাদে আহমাদ: ১৫৮৭৬
‘যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ল সে শিরক করল। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে রোজা করল সে শিরক করল। যে ব্যক্তি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে দান করল সে শিরক করল। ’ -মুসনাদে আহমাদ: ১৭১৮০
‘আমি কি ওই ব্যাপারে তোমাদের সতর্ক করব না, যে ব্যাপারটি আমার কাছে তোমাদের জন্য দাজ্জালের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর? সাহবাবারা বললেন, অবশ্যই বলুন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তা হলো- নামাজ শুরু করার পর যখন সে টের পায় কেউ তার নামাজ দেখছে তখন সে তার নামাজকে আরো সুন্দর করে। ’ -ইবনে মাজাহ: ৪২০৪
নেক আমল যদি ইখলাসের সঙ্গে করা না হয়, তাতে লোক দেখানোর বা সুখ্যাতির লাভের কোনো বাসনা থাকে, তবে আখেরাতে সে আমল কোনো কাজে আসবে না। এ বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে যেয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যাদের ফয়সালা শোনানো হবে, তন্মধ্যে একজন শহিদ হবে। তাকে ডেকে আল্লাহতায়ালা নিজের নেয়ামতের কথা স্মরণ করাবেন। সে ব্যক্তি আল্লাহর নেয়ামত ভোগের কথা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, এ সব নেয়ামতের প্রতিদানে তুমি কি আমল করেছ? সে বলবে, আমি তোমার সন্তুষ্টির জন্য জিহাদ করেছি ও শহিদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। মানুষ তোমাকে বীরপুরুষ বলবে, এ জন্য তুমি এ সব করেছ। তোমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। তোমাকে বীরপুরুষ বলা হয়েছে। এখন আমার কাছে তোমার আমলের কোনো প্রতিদান নেই। অতঃপর তাকে ফয়সালা শোনানো হবে। অধঃমুখি করে টেনে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
দ্বিতীয় ওই আলেমের বিচার হবে, যে ইলমে দ্বীন শিখেছিল, মানুষকে শিক্ষা দিয়েছিল এবং কোরআন তেলাওয়াত করেছিল। তাকে ডেকে তার ওপর আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কথা স্মরণ করানো হবে। সে ভোগকৃত নেয়ামতের কথা স্বীকার করবে। তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, ওই সব নেয়ামতের প্রতিদানে তুমি কী আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য দ্বীনের ইলম শিখেছি, শিক্ষা দিয়েছি। প্রতিউত্তরে তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি এ সব এ জন্য করেছ যে, মানুষ তোমাকে বড় আলেম বলবে, তোমাকে সম্মান করবে, সমীহ করবে। তোমার উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছ। এখন আমার কাছে তোমার আমলের কোনো প্রতিদান নেই। তাকেও ফয়সালা শোনানো হবে। অতঃপর তাকে অধঃমুখি টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
তৃতীয় ওই সমাজসেবক দানবীরকে ডাকা হবে, যাকে আল্লাহ অগাধ ধন-সম্পদ দিয়েছিলেন। সে মানুষের সেবায়, দ্বীনের সেবায়, সমাজের সেবায় অকাতরে তার সম্পদ দানও করেছে। তাকে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কথা জিজ্ঞাসা করা হবে। সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এ সব নেয়ামতের প্রতিদানে কী আমল করেছ? উত্তরে সে বলবে, আমি তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য তোমার পথে সম্পদ বিলি করেছি। প্রতিউত্তরে তাকে বলা হবে, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি এ সব করেছ মানুষের কাছ থেকে দানবীর খেতাব ও সম্মাননা লাভের আশায়। তা তো তুমি পেয়েছ। এখন আমার কাছে তোমার আমলের কোনো প্রতিদান নেই। তাকে ফয়সালা শোনানো হবে। অতঃপর তাকে অধঃমুখি টেনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ’ –সহিহ মুসলিম: ৫
আলেমরা বলেন, নিয়ত ঠিক করতে হলে প্রতিটি আমলের শুরুতে, মাঝে ও শেষে নিজের মনের নিয়ত যাচাই করতে হয়। আমলের শুরুতে বা মাঝে যদি মনে হয় নিয়তে সমস্যা আছে, আল্লাহ ছাড়া আরো কোনো উদ্দেশ্য আছে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নিয়ত সংশোধন করে নিতে হবে। আর আমলের শেষে যদি মনে হয় নিয়তের মাঝে রিয়া ছিল তবে খাঁটি মনে তওবা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৬
এমএইউ/