বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা রোজা পালন করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশে যুদ্ধ চলার কারণে ওই অঞ্চলের মানুষের জন্য রোজা পালন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
যেমন ধরা যাক শুরুতে দেওয়া ছবিটির কথা। পরিবারের আরও সদস্য থাকলেও তারা কোথায় আছে হয়ত জানা নেই এই দুই জনের। তবু যেহেতু রমজান মাস, তাই যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন আল্লাহ পাকের নির্দেশ পালনার্থে রোজা পালন করতেই হবে। আর রোজা পালন করলে দিনশেষে ইফতার করাও সুন্নত। কাজেই পরিবারটি যা কিছু মিলেছে তাই নিয়েই ইফতারে বসেছেন।
সিরীয় মুসলমানদের জন্য গত অর্ধ দশক ধরে খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে বসবাস করা সিরীয়দের জন্য। গৃহযুদ্ধে তছনছ হয়ে গেছে সিরিয়া। একসময় যারা স্বচ্ছল জীবনযাপন করতেন, তাদের অনেকে এখন হাত পাতছেন অন্যদের কাছে। কবে তাদের দুর্দশার অবসান হবে তা-ও তারা জানেন না। খাদ্যের জন্য হাহাকার করছেন অবরুদ্ধ-অসহায় নাগরিকরা। জীবন বাঁচাতে ঘাস সিদ্ধ, ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খাওয়ার কথাও শোনা গেছে। এমন এক অনাকাঙ্খিত কঠিন বাস্তবতার মুখে সিরীয় রোজাদাররা।
আরবের কেন্দ্রীয় ইফতা বোর্ডের কাছে গত বছর সোমালিয়া, ফিলিস্তিন থেকে বিবেক নাড়ানো কিছু প্রশ্ন এসেছিল। যে প্রশ্নগুলো বিশ্ববাসীর চোখের জল ফেলতে বাধ্য করেছিল। সোমালিয়া থেকে আসা প্রশ্নে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের যদি সাহরি বা ইফতার খাবার জন্য কোনো কিছু না থাকে তবে কি আমাদের রোজা হবে?’
আর ফিলিস্তিন থেকে আসা প্রশ্নে ছিল, ‘আমি মুহাম্মদ, গাজা থেকে বলছি। আমার বয়স ১১ বছর। আমার প্রশ্ন হলো- মিসাইল বিস্ফোরণের ফলে আমার মুখের ভেতর ঢুকে যাওয়া ময়লা এবং পাথরের কারণে কি আমার রোজা ভেঙে যাবে?
আর এবার রমজানে প্রশ্ন এলো সিরিয়া থেকে। প্রশ্নের ভাষ্য, ‘কেমিক্যাল অস্ত্রের আক্রমনে কি রোজা ভেঙে যাবে?’
আরবের কেন্দ্রীয় ইফতা বোর্ডে এমনই অনেক প্রশ্ন এসেছে। এই হচ্ছে বর্তমান যুদ্ধপীড়িত মুসলিম বিশ্বের অবস্থা!
পাঁচ বছরের যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় সিরিয়ার মাদায়া শহরের অধিবাসীদের কাছে সাহরি বা ইফতারি বলে কিছু নেই। সরকার নিয়ন্ত্রিত এ শহরে কয়েক মাস ধরে স্বাভাবিক খাদ্যও পাচ্ছে না অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। মাদায়া শহরের বাজারে কোনো খাদ্য কিনতে পাওয়া যায় না। যদিও কালেভদ্রে কিছু পাওয়া যায়, তার মূল্য এতটাই আকাশছোঁয়া যে, সাধারণ নাগরিকরা কেনার চিন্তাও করতে পারে না। সামান্য মটরশুটি দিয়েই রমজানের সাহরি খাচ্ছেন অনেকে।
সিরিয়ার আরেক অঞ্চল দারায়ার একজন অধিবাসী সাদি মাতার জানান, সেখানে বেশকিছু সবজি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, পার্সলি (এক ধরনের দ্বিপাতাবিশিষ্ট শাক), মুলা, আর্গুলা, পালং রয়েছে। কখনও কখনও ধুন্দলও পাওয়া যায়। সাদি বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ ছাড়া অন্যদের কাছে এগুলো নেই। দারায়া শহরে প্রায় ৮ হাজার মানুষ বাস করে। ২০১২ সাল থেকে অবরুদ্ধ এ দারায়ায় গত ১ জুন জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো ত্রাণ বিতরণ করেছিল। তবে ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে এ ত্রাণ তাদের জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়।
আমরা যখন ঈদ আনন্দে ভাসব-মাতব, স্বজন-প্রিয়জন পরিবেষ্টিত হয়ে ইবাদতকেন্দ্রিক আনন্দ উপভোগ করব, তখন সিরিয়ার মতো অসংখ্য মুসলিম উম্মাহর সদস্য জুলুমের মুখোমুখি হয়ে থাকবে। তারা কান্নাকাতর হয়ে অস্ফুটস্বরে আওয়াজ তুলবে, হে প্রভু! তুমি আমাদের জালেম অধ্যুষিত এসব জনপদ কিংবা শাসন-শোষণের হাত থেকে মুক্তি দাও, রক্ষা করো।
আল আরাবিয়ায় আবদুল্লাহ তারেক সুহাইল লিখেছেন, ‘সিরিয়ায় আড়াই লাখ শিশু ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তারা কোনো প্রকার সাহায্য বা জীবিকার অপেক্ষা নয়; অপেক্ষা করছে কেবলই মৃত্যুর!’ এ তথ্যও জানিয়েছে বিশ্বসংস্থা ‘সেভ দ্য সিলড্রেন’। তারা রিপোর্টে বলেছে, বহু শিশু ইতোমধ্যে মারা গেছে। আর যারা জীবিত আছে তারা গাছের পাতা খেয়ে দিনাতিপাত করছে। এদের মধ্য থেকে কয়েকশ শিশুর সাক্ষাতকার নেয় সংস্থাটির লোকজন। অধিকাংশেরই অভিন্ন প্রশ্ন- ‘আমি কখন মারা যাবো?’ ‘আঙ্কেল, আমার মৃত্যুর পালা কখন আসবে?’
এ শিশুরা নিঃস্ব। কিছুই করার নেই এদের। স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ। গাছের পাতা খুঁজতে খুঁজতে যে সময়টুকু যায়, এর বাকি সময়টুকু কেবলই তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর অপেক্ষা করতে থাকে- কখন আসবে মৃত্যুর পালা!
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ১৯, ২০১৬
এমএইউ/