ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

জার্মান মুসলমানদের প্রায় শতভাগই রোজাদার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০৭ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৬
জার্মান মুসলমানদের প্রায় শতভাগই রোজাদার ছবি: সংগৃহীত

এবার জার্মানির মুসলমানদের জন্য রমজান শুরু হয়েছে ভিন্নভাবে। এবার রমজান শুরুর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই মুসলমানদের সঙ্গে ইফতার করেছেন জার্মানির প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক৷

ইফতার পার্টিতে এসে জার্মান প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আজ এখানে যারা একত্রে ইফতার করছেন, তারা একমনে এ কথাও ভাবতে পারেন- এক সঙ্গে বাস করা সত্যিই সম্ভব৷’ প্রেসিডেন্ট গাউকের সঙ্গে ইফতার পার্টিতে তার স্ত্রী ডানিয়েলা শাটও গিয়েছিলেন।

২০১৫ সালের ২ জুলাই (গত রমজানে) জার্মান চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেল বার্লিনে মুসলিম কমিউনিটির দেওয়া এমন এক ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ইসলাম হচ্ছে জার্মানির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ’

এর পর সময় জার্মানির সরকারি মুখপাত্র স্টিফেন সেইবার্ট ঘোষণা করেন, মার্কেল আগামী বছর (এবারের রমজানে) প্রথমবারের মতো মুসলমানদের জন্য একটি ইফতার পার্টি আয়োজন করা হবে। এ ইফতার চ্যান্সেলরের সরকারি দফতরে অনুষ্ঠিত হবে এবং এটি হবে বার্ষিক অনুষ্ঠানমালার একটি অংশ।

উল্লেখিত বিষয়গুলোই প্রমাণ করে, জার্মানে ধীরে ধীরে মুসলমানদের অবস্থান সুসংহত হচ্ছে। জার্মানিতে গ্রীষ্মে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মধ্যে প্রায় ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টার ব্যবধান। অর্থাৎ রোজা রাখা মানেই এই লম্বা সময় কিছু না খেয়ে থাকা। বিশেষ করে, যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন তাদের জন্য অবশ্যই খুব কঠিন এ কাজ। তারপরও রমজান এলেই সাড়া পড়ে যায় জার্মান মুসলমানদের মাঝে। তারা বিপুল উৎসাহের সঙ্গে রোজা পালন করে থাকেন। তবে অনেক কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে সেখানে তাদের ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করতে হয়।

সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ মুসলিমস এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জার্মানিতে শারীরিকভাবে সক্ষম মুসলমানদের ৯৪ শতাংশই রোজা পালন করেন। বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও অনেক মুসলিম অ্যাথলেট পালন করে থাকেন সিয়ামব্রত। এমনকি জার্মান সেনাবাহিনীতে যে হাজার খানেক মুসলমান সৈন্য রয়েছে- তাদের রোজা পালনের সুবিধার্থে বিশেষ ব্যবস্থায় রাতে ক্যান্টিন খোলা রাখা হয়।

কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে রোজা শুরুর সময় ঘোষণা না করাতে প্রথম কবে রোজা শুরু করা হবে তা ঠিক করা জার্মান মুসলিমদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। ফলে জার্মানির সব মুসলিম একই সময় মেনে রোজা পালন করেন- এমন নয়। অনেক মুসলিম স্থানীয়ভাবে চাঁদ দেখে রোজা রাখেন। ফলে অন্য অনেক মুসলিমের সঙ্গে তাদের সময়ের পার্থক্য হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা এক অথবা দুই দিন পর রোজা রাখা শুরু করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অন্য মুসলিমরা যখন মুসলিমদের প্রধান উৎসব ঈদ উদযাপন করছেন; সেদিন অনেক মুসলিমকে রোজা পালন করতে দেখা যায়। এখানকার রোজাদাররাও ইউরোপের অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মতো ইফতার করে থাকে। আমাদের দেশের মতো ইফতারে বাহুল্য বিলাস তাদের পছন্দ নয়।

‘দ্য কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল অব মুসলিম ইন জার্মানি’ নামক একটি বেসরকরি সংস্থা রমজান মাসকে গুরুত্বের সঙ্গে কাজে লাগায়। তারা ওই সময় মুসলিমদের নৈতিক উন্নয়নের জন্য বহুমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রমজান মাসে তারা ইসলামের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার আয়োজন করেন। ডি জাভেদ মোগেগির মতে, ‘প্রতি বছরই ওই ধরনের আলোচনার আয়োজন করা হয়। ’ তবে সব মুসলিমই ওই আলোচনাতে অংশগ্রহণ করে এমনটি নয়।

বর্তমানে দেশটিতে দু’হাজারের মতো মসজিদ আছে। রয়েছে প্রচুর ইসলামিক সেন্টার ও নামাজের স্থান। এ সব ইসলামিক সেন্টারের তরফ থেকে রোজাদারদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যবস্থা হয় ইফতার পার্টিরও।

পশ্চিমা জগতে ইসলাম এবং মুসলমানদের অবস্থা ইসলামি ভূখণ্ডের চেয়ে অনেক আলাদা। ইসলামি ভূখণ্ড বলতে বোঝায়, যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরকম ভূখণ্ডে মুসলমানদের জীবনযাপন আর পশ্চিমা জগতে তাদের জীবনযাপন একেবারেই ভিন্ন। এ কারণে এসব দেশে ইসলামের উপস্থিতি অনেক চড়াই উৎরাইয়ের সম্মুখীন। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমা জগতে ইসলাম বিস্তারের অন্যতম কারণ হচ্ছে- সেসব দেশে মুসলমানদের বেশি বেশি হিজরত বা অভিবাসন।

১৯৬০ এর দশক থেকে মুসলমানরা তুরস্ক থেকে জার্মানিতে হিজরত বা অভিবাসন করেন এবং মুসলমান সমাজ গঠন করেন। এখন সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশ লাখের মতো। মুসলমানরা জার্মানিতে বহু মসজিদ, ইসলামি সংস্থা এবং ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। হামবুর্গে ইসলামিক সেন্টারের মতো মিউনিখেও বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে।

জার্মানিতে মুসলমান ছাত্রদের শতকরা নব্বই ভাগ ইসলামি শিক্ষার ক্লাসগুলোতে যায় এবং শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ছাত্র অংশ নেয় কোরআন শিক্ষার ক্লাসে।

জার্মানির স্থানীয় মুসলমানরা বিশেষ করে যুবক শ্রেণী সেদেশে ইসলামি সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিহিত কারণেই তারা হালাল খাদ্যের প্রতি বিশেষ নজর দেন। জার্মানির একজন খ্যাতিমান মুসলিমের নাম হলো মুরাদ আলফ্রেড হফম্যান। তিনি মরক্কোতে জার্মানির রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। মুসলমান হওয়ার পর তিনি জার্মানির সমাজে ইসলামকে পরিচিত করানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

দেশটিতে ৮ কোটি ৩০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ মুসলমান। বার্লিন, কোলন, ফ্রাঙ্কফুট, মিউনিখ, আচেন এবং মুলহেইমে মুসলমানের অবস্থান ৪ থেকে ৫ শতাংশ। জার্মান টেলিভিশনের হিসাব অনুযায়ী ২০০৬ সাল থেকে দেশটিতে প্রতিবছর চার হাজার জার্মান নাগরিক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে আছে প্রায় দুই হাজার মসজিদ। শুধু তাই নয়, এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১২০টি নতুন মসজিদ নির্মিত হয়েছে ইউরোপের এ দেশটিতে।

এছাড়াও নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন মুসলমানরা। বর্তমানে দেশটিতে মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারে আরবি ভাষা, কোরআন, হাদিস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি শিক্ষাদানের সুব্যবস্থা রয়েছে। জার্মানিতে সাধারণত দুপুরে স্কুল ছুটি হয়ে যায় এবং প্রতিদিন বিকেলে ধর্মীয় বিষয়াদির ক্লাস শুরু হয়। -সূত্র: দেশে দেশে ইসলাম ও মুসলমান

গেল নভেম্বরে প্রথম বারের মতো জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় মুসলিম সেনাদের জন্য আলাদা ধর্মীয় নেতা, ইমাম ও খতিব নিয়োগ দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদের খাবার পাকানোর জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে মুসলিম আয়া। সব মিলিয়ে একথা বলা যায় যে, জার্মানিতে সুদিন ফিরে আসছে মুসলমানদের।

বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘন্টা, জুন ২২, ২০১৬
এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।