মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। তাকে নতুন করে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আর প্রয়োজন নেই।
রমজানের শেষ ১০ দিন সংসারের সব বাঁধন ছিন্ন করে আল্লাহর ঘরে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের আশায় পড়ে থাকার নাম ইতেকাফ। এ অবস্থায় শবেকদরের সাক্ষাৎ লাভ অনেকটা সহজসাধ্য হয়।
মা হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রমজানের শেষ দশক উপনীত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সা.) সংসারধর্ম পালনের ক্ষেত্রে পূর্ণ সংযম অবলম্বন করতেন এবং ইবাদতের জন্য যেন কোমর বেঁধে নিতেন। সারারাত জেগে কাটাতেন এবং পরিবার-পরিজনের সবাইকে জাগ্রত থাকতে বলতেন। -সহিহ বোখারি ও মুসলিম
হাদিসের ব্যাখ্যাকারীরা বলেন, রমজানের শেষ দশকের ইবাদত-বন্দেগির গুরুত্ব আল্লাহর রাসূলের (সা.) কাছে এত বেশি ছিল যে, এ ১০ দিন যেমন তিনি রাতে নিদ্রা যেতেন না, সারা রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করতেন, তেমনি পরিবারের সবাইকে এ জন্য জাগিয়ে রাখতেন।
মওতের পর যে ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতো হবে, এ সম্পর্কে যাদের দৃঢ়বিশ্বাস আছে এবং যারা রমজান মাসের শেষ দশকে ইবাদতের অফুরন্ত সওয়াবের কথা জানে তাদের পক্ষে অতিরিক্ত পুণ্য অর্জন করে মৃত্যু-পরবর্তী ভয়ঙ্কর অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। রাসূলে মকবুলের (সা.) দারুণ উৎকণ্ঠা ছিল উম্মতের জন্য। স্বাভাবিক অবস্থাতেও তিনি রাতের পর রাত জেগে উম্মতের মুক্তির নিমিত্তে দোয়া করেছেন। রমজানের শেষ দশক যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা তিনি সম্যক জানতেন। আর জানতেন বলেই এ সময় নিজে জেগে ইবাদত করেছেন এবং উম্মতকেও এভাবে ইবাদত করতে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
রমজানের রাত জাগরণ এবং শবেকদরের অনুসন্ধান সম্পর্কিত হাদিসগুলোয় এমন একটি শব্দ সংযুক্ত হয়েছে, যা নিতান্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শব্দটি হচ্ছে ঈমান এবং প্রতিদানপ্রাপ্তির পূর্ণ আশাসহ। এ শব্দের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহতায়ালার কাছে ফল পাওয়ার একিন যত দৃঢ় হয়, ইবাদতে মনোযোগও তত গভীর হয়। এ জন্যই দেখা যায়, মানুষ আল্লাহতায়ালার যতটা নিকটবর্তী হয়, তার মধ্যে ইবাদত-বন্দেগিতে নিবিষ্টতাও সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
রমজানের পরিশিষ্ট হচ্ছে ঈদ এবং ঈদের সকাল বেলায় সদকাতুল-ফিতর প্রদান করতে হয়। এটা সর্বশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সহমর্মিতা প্রকাশ করার চূড়ান্ত পর্যায়। ঈদের আনন্দে কেউ আটখানা হয়ে ফেটে পড়বে আর কেউ কঙ্কালসার নগ্নদেহে তা দূর থেকে দেখবে- এ দৃশ্য সমাজে থাকতে পারে না। ঈদ হচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে রমজান অতিবাহিত করতে পারার আনন্দ। আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ দান পবিত্র কোরআনপ্রাপ্তির আনন্দ। কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ়করণের আনন্দ। যে সমাজে একশ্রেণীর মানুষ ভোগ-বিলাস আকাশচুম্বি এবং অন্য শ্রেণী ভোখা-নাঙ্গা, সে সমাজ কোরআন অনুসারী নয়। তাই ঈদের আনন্দ আকর্ষণীয় পোশাক এবং উপাদেয় খাদ্য-পানীয়ের সমারোহ নয়। ঈদের আনন্দ কোরআন প্রদর্শিত সমাজনীতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায়। সব শ্রেণীর মানুষের বুকে বুক মিলিয়ে আনন্দ প্রকাশ করার মতো পরিবেশ সৃষ্টিতে। বস্তুত এটাই রমজানুল মোবারকের সাধনা।
রমজান আমাদের যেসব পার্থিব কল্যাণ সাধন করে, সে তালিকাও অত্যন্ত দীর্ঘ। একমাস রোজা রাখার ফলে স্বাস্থ্যের ওপর যে কল্যাণকর প্রভাব পড়ে, সে সম্পর্কে বিশ্ববিখ্যাত বহু স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। শরীরের অতিরিক্ত মেদ এবং পাকস্থলীতে জমে থাকা অনেক ক্ষতিকর উপাদান রোজার মাধ্যমে অপসারিত হয়।
রোজাদার অবস্থায় অনেক হালাল বস্তুর ব্যবহারও সযত্নে পরিহার করতে হয়। এর দ্বারা যেমন আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়াদি থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে ওঠে, তেমনি ব্যক্তির জীবনে ত্যাগের মনোভাবও সৃষ্টি হয়ে যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, যে সমাজে ভোগের তুলনায় ত্যাগের প্রবণতা বেশি হবে, সে সমাজ পরিবেশকে বেহেশতি পরিবেশরূপে আখ্যায়িত করা বোধহয় অবান্তর হবে না।
এক কথায়, রোজা তথা সিয়াম সাধনার নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং ধর্মীয় উপকারাদির পাশাপাশি পার্থিব কল্যাণও উপেক্ষা করার মতো নয়। সেদিক লক্ষ্য করলে সিয়াম শুধু ইবাদতই নয়, মানব কল্যাণের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও বটে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, জুন ২৫, ২০১৬
এমএইউ/