রোজা শুরুর কয়েক দিন যাবত লক্ষ করলাম, মধ্যবয়সি এক লোক সাহরির সময় রোজ রোজাদারদের ডেকে দেন। প্রতিদিন নিয়ম করে আড়াইটার সময় শুরু করে ফজরের আজানের আধাঘণ্টা আগ পর্যন্ত এলাকায় ডাকাডাকি করেন।
সেই মাইকের সাহায্যে তিনি মায়াবি সুরে ডেকে চলেন- ‘উঠুন, ঘুম থেকে জাগুন, সাহরি খাওয়ার সময় হয়েছে। আর ঘুমায়া থাকবেন না। উঠুন, ঘুম থেকে জাগুন!’
সোমবার সাহরির সময় লোকটির সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা হলো। দ্রুত নিচে নেমে এলাম। ডেকে গেইটের কাছে আনলাম। পাঁচ মিনিট সময় চাইলাম আলাপ করার জন্য।
তিনি বললেন, ‘এখন কথা কওন যাইব না, পাঁচ মিনিটে অন্তত পঞ্চাশজন লোককে ডাইক্যা তুলতে অইব। ’
কথা না বাড়িয়ে বললাম, ঠিক আছে আপনার লোক ডাকাডাকি শেষ হলে একটু আসবেন? ‘হ্যাঁ’সূচক জবাব দিয়ে লোকটি আবার ডাকতে শুরু করল- ‘উঠুন, ঘুম থেকে জাগুন, আর ঘুমায়া...!’
তিনি কথা রাখলেন, আসলেন মিনিট দশেক পর। তার সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বিগত ১৮ বছর ধরে রমজান মাসের সাহরির সময় এভাবে রোজাদারদের ডেকে দেন তিনি। শুরুর দিকে ছয়-সাত বছর পর্যন্ত প্লেট, টিনের ডিব্বা ইত্যাদিতে আওয়াজ করে মানুষদের ঘুম থেকে জাগাতেন। এখন তিনি হ্যাণ্ডমাইকের সাহায্যে লোকজনকে ডাকাডাকি করেন।
তার নাম- মুহাম্মদ ফারুক। বাবা জয়নাল আবেদীন। রাজধানীর মুহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকায় থাকেন। গ্রামের বাড়ি বরিশালের গৌরনদীতে। দুই মেয়ের জনক ফারুকের ঘরে বৃদ্ধ বাবাও থাকেন। সাত মসজিদ এলাকায় ইলেকট্রনিক্সের ছোটখাটো ব্যবসা করেন।
সাহরিতে কষ্ট করে মানুষকে ডাকাডাকি করেন কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আঠার বছর আগে আমি যখন নামাজ-রোজা শুরু করি তহন কিছুই করতাম না। এমনি এমনি সময় নষ্ট করতাম। একদিন মনে অইল, সাহরির সময় ঢাকা শহরের অনেক লোক ঘুমায়া থাকে। ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠতে পারে না। তাদের আমি যদি ডাইক্যা জাগায়া দিতে পারি- তাহলে সওয়াব হবে। সেই ভাবনা থেকে এ কাজ শুরু করি, এখনও করছি। ’
এখনতো ঢাকার মসজিদে মসজিদে মাইকে সাহরির জন্য ডাকা হয়, আপনার কি দরকার? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরের মসজিদে মসজিদে মুয়াজ্জিন সাবরা ডাইক্যা দেন ঠিকই; কিন্তু বড় বড় বিল্ডিংয়ের কারণে এই আওয়াজ সব বাসায় পৌঁছায় না। তাই আমি গলি গলি গিয়ে ডাইক্যা দেই। ’
-এভাবে ডাকার জন্য মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা নেন?
-আমি সওয়াবের আশায় কাজ শুরু করি। শুরুতে অনেক বছর কারও কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা নেই নাই। এখন অনেকে নিজের খুশিতে কিছু দেয়। আমি কারও কাছ থেকে টাকা দাবি করি না। যার যত ইচ্ছা দেয়।
-তাতে কত পান?
-যার যত মন চায় দেয়। কেউ বিশ টাকা, কেউ ত্রিশ টাকা, কেউ পঞ্চাশ টাকা দেয়।
-সর্বনিম্ন কত আর সর্বোচ্চ কত পেয়েছেন?
-সর্বনিম্ন চার টাকা আর সর্বোচ্চ পাঁচ শত টাকা পর্যন্ত পাইছি।
-কোন কোন এলাকায় ডাকেন?
-মোহাম্মদপুরের আলী নুর রিয়েল এস্টেট, স্বপ্ননীড় হাউজিং আর বস্তি এলাকায় ডাকি। আগে চাঁন মিয়া হাউজিংসহ আরও কিছু এলাকায় ডাকতাম। ওখানে প্রভাবশালী কিছু লোক আর ডাকতে দেয় না। তারাই ডাকে।
-কতদিন পর্যন্ত এ কাজ করতে চান?
-আল্লাহ তওফিক দিলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ কাজ করতে চাই। এই কাজ করার জন্য দীর্ঘ এগারো মাস আমি অপেক্ষা করি। রমজানের শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত করি। আমি যেন মৃত্যৃর আগ পর্যন্ত সুস্থতার সঙ্গে আল্লাহর জন্য কাজটি করতে পারি- সে জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
আরও কথা বলার ছিলো। কিন্তু তার হাতে সময় নেই। নিজে সাহরি খাবেন, অন্যদেরও খাওয়ার জন্য ডাকতে হবে।
মুখে মাইকের লাগিয়ে বলা শুরু করলেন, ‘উঠুন, ঘুম থেকে জাগুন, সাহরি খাওয়ার সময় হয়েছে..., আর ঘুমায়া থাকবেন না...।
ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, জুন ০৫, ২০১৭
এমএইউ/