ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অপার মহিমার রমজান

ইতিকাফে পরিচয়, ভ্রাতৃত্বের বাঁধন!

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০২ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৭
ইতিকাফে পরিচয়, ভ্রাতৃত্বের বাঁধন! ময়মনসিংহ বড় মসজিদে ইতিকাফে মশগুল মুসল্লিদের একাংশ: ছবি- অনিক খান

ময়মনসিংহ: কারও সঙ্গে কারও কোনো পরিচয় নেই। একেকজনের বাড়ি একেক জায়গায়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে তারা এসেছেন। কিন্তু একদিনেই কী মহব্বত! দিন গড়াতেই প্রগাঢ় বন্ধুত্ব!

রচিত হয় ভ্রাতৃত্বের বাঁধন। ঈদ দূয়ারে কড়া নাড়লেও সেদিকে কারও নজর নেই।

শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার ইবাদতে নিজেকে নিবেদিত করতে পরিবার-স্বজন ছেড়ে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা সময় কাটে মসজিদের চার দেয়ালের ভেতরে।

নিরবিচ্ছিন্নভাবে রমজানের শেষ ১০ দিন আল্লাহর ইবাদতে নিজেদের মগ্ন রেখে শাওয়াল মাসের চাঁদ উঠলেই তবেই ভাঙবে এ মিলনমেলা। ইতিকাফে শেষে একে অন্যের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। এরপর নাড়িপোতা ভিটার খুঁজে ছুটে চলা ঘর পানে।

বছরের প্রতিটি রমজানের শেষ দশকে ময়মনসিংহ নগরীর ঐতিহ্যবাহী বড় মসজিদের চিত্র এমনই। ব্যতিক্রম নয় এ বছরও।

ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি ১৮৫০/১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন জমিদারের মৌখিক অনুমতিক্রমে মুসলমানরা নির্মাণ করেন। কালের স্রোতধারায় সেই ছাপড়া মসজিদটিই ময়মনসিংহের গর্ব ও ঐতিহ্যের স্মারক ‘বড় মসজিদ। ’ ১৯৩৫ সালের বেঙ্গল ওয়াকফ্ অ্যাক্টের অধীনে মসজিদটি পাবলিক এস্টেটে পরিণত হয়।

প্রায় ০১.৯ একর জমির ওপর নির্মিত বড় মসজিদটি তিনতলা। অপূর্ব অলঙ্করণে সুশোভিত মসজিদের ১২৫ ফুট উঁচু দু’টি মিনার ও একটি কেন্দ্রীয় সুবৃহৎ গম্বুজে ব্যবহৃত হয়েছে চীনামাটির তৈজষপত্রের টুকরা দিয়ে তৈরি নান্দনিক নকশা।  

এই মসজিদে হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.) ১৯৪১ থেকে ১৯৯৭ সালা পর্যন্ত টানা ৫৬ বছর ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবে এ মসজিদের সুনাম সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তার দীর্ঘদিনের মেহনতের ফসল আজকের ময়মনসিংহের বৃহত্তম বড় মসজিদ।  

মসজিদ পরিচালনাকারী কমিটি সাবেক ইমাম হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.)-এর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার উদ্দেশ্যে মসজিদ সংলগ্ন মাদরাসাটির তার নামে নামকরণ করেন- ‘জামিয়া ফয়জুর রহমান (রহ.)। ’

১৯৯৭ সাল থেকে আল্লামা শায়খ আবদুল হক সাহেব অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

ময়মনসিংহ বড় মসজিদে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজনের এসে ইতিকাফ করার রীতি চালু হয় ইমাম হজরত মাওলানা ফয়জুর রহমান (রহ.)-এর সময়। মূলতঃ তার ভক্ত-অনুসারীরা শেরপুর, জামালপুর, মুক্তাগাছা, নেত্রকোনা ও টাঙ্গাইলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে এখানে ইতিকাফে বসতেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে।  

ময়মনসিংহ বড় মসজিদে ইতিকাফে মশগুল মুসল্লিদের একাংশ: ছবি- অনিক খান
শুক্রবার (১৬ জুন) আসরের নামাজের আগে থেকেই ইতিকাফ পালন করতে এ মসজিদে জড়ো হয়েছেন বগুড়ার জালাল উদ্দিন (৬০), জামালপুরের আবুদস সালাম (৭০) ও টাঙ্গাইলের আবু বক্কর (৫৯)।

শুধু তারা নয়, ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের মশগুল করতে তাদের মতো এখানে আসা মুসল্লিদের সংখ্যা কম করে হলেও ৫ শতাধিক।  

ময়মনসিংহ বড় মসজিদের নিচ তলা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় তারা উঠেছেন। প্রত্যেকের সঙ্গে রয়েছে রাত যাপনের জন্য রয়েছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।  

একেকজন বসে গেছেন শেষ দশকের ইতিকাফের নিয়তে। কেউ নিবিষ্টমনে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। প্রায় সবার হাতে তসবিহ। কেউ করছেন জিকির।

আধ্যাত্মিক সাধনার এমন আবহের মধ্যে দিয়ে ইতিকাফকারীদের মহান আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার নিরন্তর সব প্রয়াস।

বগুড়ার একটি হাফেজিয়া মাদরাসায় দীর্ঘদিন মোহতামিমের দায়িত্ব পালন করেছেন জালাল উদ্দিন। ষাটোর্ধ্ব এ মাদরাসা শিক্ষক জীবনের শেষ বেলাতে প্রথমবারের মতো ইতিকাফ পালন করতে চলে এসেছেন এখানে। মসজিদের পেশ ইমাম আল্লামা আবদুল হকের গুণমুগ্ধ তিনি।

আলাপচারিতায় বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতেই তার ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে ইতিকাফ করতে এসেছি। দুনিয়ার সব কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে রমজানের শেষ দিকে ইতিকাফের জন্য এ শ্রেষ্ঠ মসজিদকে বেছে নিয়েছি।  

তার সঙ্গে আলাপের সময়েই কাছে এসে বসলেন জামালপুর জেলা সদরের নরুন্দি এলাকার বয়োবৃদ্ধ আবুদস সালাম।

তিনি জানান, নিজের জীবনের একটি বড় ভাগই তিনি ইতিকাফ করেছেন ময়মনসিংহ বড় মসজিদে। ২৬ বছর যাবত এ মসজিদেই ইতিকাফ করেছেন।

খুশির বারতা নিয়ে ঈদ ঘনিয়ে এলেও এসব নিয়ে তার কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই। তার কথা হলো- সংসারের সব কাজ গুছিয়ে এসেছি।

নিজেকে প্রস্তুত করেই আল্লাহর রাস্তায় এসেছি। মসজিদে থেকে আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে মশগুল রেখে এ দিনগুলো কাটাতে চাই।

টাঙ্গাইলের নঈমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আবু বক্করের (৫৯) চাকরি শেষ হবে সামনের বছর। স্থানীয় গোপালপুর নালন বাজারে তার বাড়ি।

গত ৩ বছর যাবত এ মসজিদেই ইতিকাফ করছেন। মসজিদের পেশ ইমাম আল্লামা আবদুল হকের বয়ান তার খুব প্রিয়।  

তিনি বলেন, ছেলে-মেয়েরা এখন বড় হয়েছে। সংসারের সব দায় দায়িত্ব এখন তাদের। আর ইতিকাফ করাটা ভীষণ সৌভাগ্যের বিষয়। আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে এ সামান্যটুকু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা নিয়েই এখানে এসেছি।

ইতিকাফ করতে আসা জেলার ত্রিশাল উপজেলার এক ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক বলেন, দুনিয়ার সংশ্লিষ্টতা থেকে নিজেদের দূরে রেখে আল্লাহর জন্য নিজেকে নিবেদিত করতে যারা ইতিকাফে আসেন তাদের কারো সঙ্গে কারও আগে থেকে কোনো পরিচয় নেই।

কিন্তু ইতিকাফ চলাকালীন সময়েই নিজেদের মধ্যে হৃদ্যতা-সখ্যতা গড়ে উঠে। এ বন্ধুত্ব টেকেও আমৃত্যু।  

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২০০৩ ঘণ্টা, জুন ১৮, ২০১৭
এমএএএম/ এমএইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।