লক্ষ্মীপুর: রামগতি-কমলনগর উপজেলার বন্যার প্রধান কারণ ছিল ভুলুয়া নদী। বর্ষা মৌসুমে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের পানি ভুলুয়া নদী হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে পড়ে।
যে ভুলুয়ার কারণে বন্যায় ডুবেছে দুই উপজেলা লক্ষাধিক মানুষ, সে ভুলুয়ায় এখন হাঁটুপানিও নেই। বৈশাখের বৃষ্টির আগেও নদীর বিভিন্ন স্থান শুকিয়ে চৌচির হয়ে ছিল। এখনকার ভুলুয়া দেখে বোঝার উপায় নেই, কয়েক মাস আগেও রাক্ষসী রূপে আর্বিভূত হয়ে ঘরবাড়ি, ফসলি মাঠ ভাসিয়েছে নদীটি।
ভুলুয়া ‘মৃত’ হওয়ার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে স্থানীয়দের দখল, আর মাছ শিকারের বাঁধকে। আর দীর্ঘ সময় ধরে ভুলুয়ার দখলদারিত্ব নিয়ে কিংবা পুনঃখননে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। এ সুযোগে এ নদীকে ‘গলাটিপে’ যেন হত্যা করা হয়েছে।
তবে ভুলুয়ার এমন করুণ দশার কারণে একদিকে যেমন বন্যার কবলে পড়ছে বাসিন্দারা, অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন থেকে বাদ যাচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। পরিকল্পিত খননে ভুলুয়ায় ফিরতে পারে প্রাণ, বর্ষায় বাসিন্দারা রক্ষা পাবে বন্যা থেকে। ভুলুয়ার পানি দিয়ে অনাবাদি জমিতে সোনালী ফসল ফলাতে পারবে কৃষকেরা। এমনটাই মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও দুই পাড়ের বাসিন্দারা।
জানা গেছে, গেল বর্ষা মৌসুমে যখন বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে, ঠিক তখনই ভুলুয়া পুনরুদ্ধার এবং খননের জন্য আন্দোলন শুরু করে আব্দুস সাত্তার পলোয়ান নামে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। এ লক্ষ্যে উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি। বন্যাকালীন নিজেই ভুলুয়ায় নেমে পড়েন বাঁধ ও মাছ শিকারে পেতে রাখা অবৈধ বাঁধ এবং জাল অপসারণে।
গতবারের ভয়াবহ বন্যায় ভুলুয়ার সংকট যখন সামনে চলে আসে, তখন নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু বন্যার অতিরিক্ত পানির কারণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।
ভুলুয়ার উৎপত্তি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ভুলুয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি অভ্যন্তরীণ নদী। এটি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়নের ওয়াপদা খাল থেকে উৎপন্ন হয়ে কমলনগর-রামগতি উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নোয়াখালী সদর উপজেলার হয়ে সুবর্ণ চর উপজেলার চর জুবলি ইউনিয়নের উপর দিয়ে পুনরায় রামগতি হয়ে মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৭৬ কিলোমিটার, সর্বোচ্চ প্রস্ত ২৩৫ মিটার। গড় গভীরতা ২০ মিটার। এটি মৌসুমি প্রবাহ বিশিষ্ট নদী। নদীর ভূখণ্ডের ডাল শূন্য দশমিক ছয় সেন্টিমিটার।
ভুলুয়ার বর্তমান অবস্থা
সম্প্রতি ভুলুয়া নদীর তীরবর্তী কমলনগরের চরকাদিরা ইউনিয়ন থেকে রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের আজাদনগর স্ট্রিল ব্রিজ হয়ে নোয়াখালীর চর জুবলী ইউনিয়ন থেকে পুনরায় রামগতির ব্রিজঘাট পর্যন্ত পরিদর্শন করা হয়৷ এতে দেখা যায়, ভুলুয়ার দুইপাড় সংকুচিত হয়ে পড়েছে। পলি জমে ভরাট হয়ে পড়ায় নেই গভীরতা। নদীর উপরিভাগ কমলনগর উত্তর-পূর্ব এবং নোয়াখালীর পূর্বাংশ। আর নদীর নীচেরভাগ নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চর জুবলি হয়ে রামগতির ব্রিজঘাট পর্যন্ত। কিন্তু পরিদর্শনে দেখা গেছে, নদীর নিচু অংশ পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নিচুভাগ উপরিভাগের তুলনায় উঁচু হয়ে পড়েছে।
ভুলুয়া গিলে খেয়েছে স্থানীয়রা
নদীর বেশিরভাগ অংশ জুড়েই মৎস্য শিকারিদের অবৈধ বাঁধ। এতে নদীর মাঝ অংশ সংকুচিত হয়ে আছে। বাঁধের কারণে নদীর বিভিন্ন অংশে চর জেগেছে। ভুলুয়ার রামগতি অংশের আজাদনগর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় দুইপাশ দখল করে বসতি স্থাপন করেছে দখলদাররা। নদীর ভেতর ভরাট করে মৎস্য খামার (পুকুর) কিংবা বাগান তৈরি করছে অনেকে। অপরিকল্পিত ভাবে ইটভাটার জন্য মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে, যার ফলে কোথাও উঁচু আবার কোথাও নিচু।
ভুলুয়া মৃতের জন্য দায়ী নিচু ব্রিজ কালভার্ট
নদীটির কমলনগর এবং রামগতি অংশে ছোটবড় অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট দেখা গেছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। বন্যার সময় পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নিচু কালভার্টের কারণে বন্যার পানি প্রবাহে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ঠিকমতো পানি নামতে না পারায় অতিরিক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে।
ভয়াবহ বন্যায় ভুলুয়া পাড়ে ছিল হাহাকার, ব্যাপক ক্ষতির শিকার বাসিন্দারা
গেল সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে ভয়ভহ বন্যার কবলে ছিল ভুলুয়ার রামগতি ও কমলনগর উপজেলার বাসিন্দারা। ফেনীতে যখন উজানের পানি চাপ দেয়, সেই পানি নোয়াখালীর উপর দিয়ে ভুলুয়া নদী হয়ে রামগতির মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নদীর তলদেশ ভরাট, অবৈধ দখল, মাছ ধরার বাঁধ-জাল, নিচু ব্রিজের রেলিংয়ের কারণে পানি প্রবাহ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে পানি মেঘনায় প্রবাহিত না হয়ে নদীর দুই কূলের লোকালয়ে প্লাবিত হয়েছে। এতে ডুবেছে বসতবাড়ি, মৎস্য খামার, আর ফসলি জমি। কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের একাংশ, চরকাদিরা ইউনিয়নের পূর্ব অংশ, রামগতি উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নের পূর্ব চরসীতা, চর আলগী, চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছিল বন্যা কবলিত। এক থেকে দেড় মাস, কোথাও আবার দুই পর্যন্ত পানিবন্দি ছিল লাখ লাখ মানুষ। দীর্ঘ মেয়াদি বন্যার কবলে পড়ায় দুর্গতদের মধ্যে হাহাকার দেখা গেছে। বন্যায় ফসলের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমন ক্ষতি হয়েছে বসতঘরের। ভেসে গেছে পুকুর-জলাশয়ের মাছ। গবাদিপশু নিয়েও দুর্ভোগে ছিল গৃহস্থরা। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষিতেও। কৃষকরা জানিয়েছেন, বন্যা যখন শুরু হয়, তখন ক্ষেতে আমনের বীজতলা ছিল, আবার কোনো কোনো ক্ষেতে সদ্য আমনের চারা লাগানো ছিল। বিভিন্ন শাকসবজির আবাদও ছিল জমিতে। বন্যার পানিতে সবি তলিয়ে যায়। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এদিকে দীর্ঘ সময় বসতবাড়িতে পানি থাকায় অনেকের বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও কারও ঘর পড়ে যায়। পচে গেছে ঘরের বাঁশ-কাঠ। অর্থ সংকটে এখনো জরাজীর্ণ ঘর মেরামত করতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্তরা।
‘মৃত’ ভুলুয়াকে পুনর্জীবিত করতে প্রয়োজন পুনঃখনন
ভুলুয়া নদী নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত কয়েক দশক ধরে নদীর তলদেশে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি জমা হয়ে ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীর পানি পরিবহন হ্রাস পেয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদন, জীবিকা নির্বাহের সুযোগ সুবিধা গুরুতরভাবে ধস নেমেছে। দীর্ঘ সময় নদী ড্রেজিং বা খনন না করায় নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজের জন্য পানির অপ্রাপ্যতা ও বর্ষা মৌসুমে পোল্ডার অভ্যন্তরীণ নিচু এলাকার পানি নিষ্কাশনে অপ্রাচুর্যতা সৃষ্টি হয়। পুনখনন না করায় নদীতে অবৈধ দখল ও দূষণের ফলে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে ভরাট হয়ে গেছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবনা
নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং বা খনন প্রকল্পের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে বলা হয়েছে, ভুলুয়ার নাব্যতা না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে লক্ষ্মীপুর এবং নোয়াখালী জেলার পাঁচটি উপজেলার সেচ সুবিধা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পুনঃখননের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি পানি ধরে রাখার মাধ্যমে এ ৫ উপজেলার প্রায় ৫২৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সেচ সুবিধায় আসবে। এতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং আত্ম সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
কৃষির জমির গুরুত্ব তুলে ধরে প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, ভুলুয়ার দুই তীরে থাকা কৃষি জমিতে সেচ সুবিধার অপ্রতুলতাসহ বিভিন্ন কারণে শস্য নিবিড়তা আশানুরূপ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যেসব এলাকায় পানি সেচের ব্যবস্থা বৃষ্টি বা ভূ-উপরস্থ পানির পানির উপর নির্ভরশীল, সে স্থানে শস্য নিবিড়তা তুলনামূলক কম। সেখানে আবাদযোগ্য জমিতে পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা পৌঁছানো গেলে শস্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। ভূ-উপরস্থ পানির প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ ও নিষ্কাশনের উপর গুরুত্ব দিয়ে বেশি পরিমাণে খাল খনন ও পুনঃখননের মাধ্যমে ভুলুয়া নদীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে সেচ সুবিধার আওতায় আনতে হবে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান খান বলেন, ভুলুয়া খনন হলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক হবে। বর্ষা মৌসুমে উপরের পানি নদীতে গিয়ে পড়বে। আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি ভুলুয়াতে ঢুকবে। এতে একদিকে যেমন বন্যা বা জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে কৃষিকাজে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। নানামুখী উপকৃত হবে স্থানীয় বাসিন্দারা। ভুলুয়া খননে একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। সেটি সার্ভে করে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২৫
এমজে