ঢাকা, রবিবার, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ জুলাই ২০২৫, ০১ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

জুলাইগাথা

আন্দোলনে যায় দুই সহোদর, আ.লীগ ক্যাডারদের গুলি কেড়ে নেয় বড়ভাইকে

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৫৫, জুলাই ২৬, ২০২৫
আন্দোলনে যায় দুই সহোদর, আ.লীগ ক্যাডারদের গুলি কেড়ে নেয় বড়ভাইকে জুলাই শহীদ কাউছার হোসেন

লক্ষ্মীপুর: জুলাই অভ্যুত্থান দমনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ ও তার দল আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের গুলিতে যখন সারাদেশে ছাত্র-জনতার প্রাণ ঝরছিল, তাতে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছিল দেশের সাধারণ মানুষ। অন্য সবার মতো লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেনের বড় ছেলে কাউছার হোসেন ও বিপুল হোসেনও প্রতিবাদের কাতারে শামিল হন।

যোগ দেন আন্দোলনে।

চূড়ান্ত আন্দোলন দমনে ৪ আগস্ট শেখ হাসিনা তার দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের ক্যাডারদের রাস্তায় নামতে নির্দেশ দেন। এই ক্যাডার বাহিনী সারা দেশের মতো লক্ষ্মীপুরেও নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। এতে সেদিন ইসমাইল হোসেনের ছোট ছেলে বিপুল হোসেন বেঁচে গেলেও শহীদ হন বড় ছেলে কাউছার।

উত্তর জয়পুর গ্রামের বাড়িতে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কাউছারের মা জোসনা আক্তার বাংলানিউজকে বলছিলেন, “আমার ছেলে মেধাবী ছাত্র ছিল। তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার৷ আমাদের সে সবসময় বলতো—‘আমি একদিন বিসিএস ক্যাডার হবো’। আমার ছেলের সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না৷ সে এখন মাটির নিচে। ”

কাউছার লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। ৪ আগস্ট লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের তমিজ মার্কেটে সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুর বাসভবনের ছাদ থেকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে গুলি ছুড়তে থাকলে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কাউছার। সেদিন তার সঙ্গে আরও তিনজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী শহীদ হন।  

ঘটনার দিনের স্মৃতিচারণ করে কাউছারের মা জোসনা আক্তার বলেন, “আমার ছেলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। কিন্তু নিজে একজন ছাত্র হিসেবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেত। আমি তাকে বারবার নিষেধ করতাম। আমার সব কথা সে শুনতো, কিন্তু এ কথা সে শুনলো না৷ আমার ছোট ছেলেটাও আন্দোলনে যেতে চাইতো। ৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কাউছার কিছু না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। আমি তার পথ আগলে রেখেছি, আটকাতে পারিনি। আমার গালে চুমু খেয়ে বলেছে, ‘মা আমি ফিরে আসবো’। দুপুর ২টার দিকে তার মোবাইলে কল দিই, নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকার কারণে স্পষ্ট কথা শুনতে পারিনি। তবে সে বলেছে, ‘মা আমি ঝুমুরের সামনে (আন্দোলনের স্থান) আছি। আমি ভালো আছি। ’ শুধু এ কথাটা বুঝতে পারি। ” 

জোসনা আক্তার বলেন, “বিকেলে আমার মেয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে কান্না করে আমাদের বাড়িতে এসে বলে, ‘কাউছার গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছে। ’ এ কথা শুনে আমি যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলি—এমন অবস্থা হয়েছে। মেয়ে আর তার চাচাকে নিয়ে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথে পথে আওয়ামী লীগের লোকজন বাধা দেয়। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার কলিজার ছেলে শুয়ে আছে। আমি তাকে এতো ডাকছি, আমার সঙ্গে সে কথা বলে না। সে তো লাশ হয়ে পড়ে আছে। যে ছেলে সকালে বাড়ি থেকে বের হলো, বিকেলে সে লাশ হয়ে পড়ে রইল। এক বছর পার হলো, আমার ছেলে মায়ের সাথে আর কথা বললো না। ’

ছেলের কবিতার খাতায় হাত বোলান বাবা, ছলছল করে চোখ
ছেলে কবি হবে, উপন্যাস লিখবে- এমন আশা ছিল বাবা ইসমাইল হোসেনের। জুলাই অভ্যুত্থানে ছেলে শহীদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবার সেই স্বপ্নও মুছে গেছে। তাই তো ছেলের লেখা কবিতার খাতা খুলে লেখাগুলোতে হাত বোলাচ্ছিলেন ইসমাইল। ছোখ ছলছল করছিল ছেলে হারানোর বেদনায়৷ ছেলের শূন্যতা যেন ভুলতে পারেন না। তাই তো ছেলের লেখা কবিতা পাঠ করে তার শূন্যতা ভুলে থাকার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু খাবার টেবিলে ছেলেকে না পেয়ে শূন্য বুকটা যেন হু হু করে ওঠে।  

শহীদ সন্তানের স্মৃতি ও সনদপত্র হাতে কাউছারের মা-বাবা।  ছবি: বাংলানিউজইসমাইল হোসেন বলেন, “কাউছার একদিকে যেমন মেধাবী ছিল, অন্যদিকে ভদ্র-নম্র স্বভাবের ছিল। সে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। মৃত্যুর এক বছর আগেও মাদকের ওপর রচনা লিখে পুরস্কার পেয়েছে। গল্প-কবিতা লিখতো সে। খাতায় তার অনেক কবিতা লিখে গেছে। আমাকে বলতো, ‘বাবা আমি একদিন কবি হবো, উপন্যাস লিখবো, আমার কবিতার বই বের হবে। ’ আমার কবি ছেলেটা আর ফিরে এলো না৷”

চট্টগ্রামের পটিয়ায় একটি শিপইয়ার্ডে কাজ করেন ইসমাইল হোসেন। তিনি সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “ঘটনার দিন আমি কর্মস্থলে ছিলাম। দুপুর দেড়টার দিকে আমার সঙ্গে ছেলের মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে, বলেছে, ‘কোনো সমস্যা নেই, তুমি দোয়া করিও’। বিকেল ৪টার দিকে আমার ভাই ফোন করে জানান, আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। সেখানেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে রাতেই একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হই। ভোরবেলার দিকে বাড়িতে আসি। এদিন দুপুরে জানাজার নামাজ শেষে ছেলেকে দাফন করি। ”

স্বজনদের ভাষ্যে, ইসমাইল যেন এখনো বিশ্বাস করতে চান না, তার ছেলে আর কখনো ফিরবেন না। তার ধারণা, ছেলে হয়তো কলেজে গেছেন, ফিরে আসবেন। খাবার টেবিলে বসে একসঙ্গে খাবেন। কিন্তু যখন খাবার টেবিলে শূন্যতা দেখেন, সারাদিনে ছেলের আর ফেরা হয়নি, তখন যেন তার বুকটা ফেটে যায়।  

ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। তার ব্যক্তিগত সবকিছুই আমার কাছে শেয়ার করতো। তারা দুই ভাই, এক বোন। সবার সঙ্গে সবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আর্থিক টানাপোড়েন থাকলেও হাসিখুশি পরিবার ছিল আমাদের। ’

টিউশনি করে যা পেতেন, মায়ের হাতে তুলে দিতেন কাউছার
মা জোসনা আক্তার বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে ছেলেদের লেখাপড়া করাচ্ছি। বড় ছেলে কাউছার পালপাড়া ডিএম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চন্দ্রগঞ্জ কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে স্নাতকে ভর্তি হয়৷ অনেক দূরের কলেজ, বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করতো। তার কলেজের যাতায়াত ভাড়া দিতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। সংসারে আর্থিক সংকট থাকায় সে এলাকায় টিউশনি করতো। মাসে ১০ হাজার টাকা পেত, সব টাকা আমার হাতে এনে তুলে দিত। আমার মেধাবী এবং বিসিএসের স্বপ্ন দেখা ছেলেটা এখন কবরে শুয়ে আছে। ’

‘ভাইয়ের সঙ্গে ভাত খাবেন বলে অপেক্ষায় ছিলেন মা’
কাউছারের ছোট ভাই বিপুল বলেন, “১৫ জুলাই ঢাকায় যখন শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের লোকেরা হামলা করে, ওটা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার বড়ভাই এসব বিষয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। আমি গোপনে লক্ষ্মীপুরে আন্দোলনে অংশ নিতাম। আমার আম্মুর বাধা উপেক্ষা করে ৪ আগস্ট সকালে আমি লক্ষ্মীপুর শহরের আন্দোলনে যোগ দিতে বের হই। হাজিরপাড়া বাজার পর্যন্ত গিয়ে যুবলীগের বাধার মুখে পড়ি। মান্দারি বাজারে এসে ছাত্রলীগের হামলার মুখে পড়ি। তখন বড় ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি আমাকে বাড়িতে চলে যেতে বলেন। দুপুর আড়াইটার দিকে আবারও ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়, তখন তিনি বলেন- ‘আমি সেফ (নিরাপদ) আছি’। ”

বিপুল বলেন, ‘ওইদিন আমার আম্মু আমার ভাইয়ের অপেক্ষায় ছিলেন, ভাই আসলে দুপুরে ভাত খাবেন। আমার ভাই আর ফিরে আসলেন না। সেদিন থেকে মা আর ঠিকমতো ভাতও খেতে পারেন না। ভাত খেতে বসলে ভাইয়ের কথা মনে পড়ে।

শহীদ কাউছারের পরিবার এখন হত্যাকাণ্ডের বিচারের অপেক্ষায়। বিচার চেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাও দায়ের করেছেন।  

তার বা-মা জানান, তারা কোনো দান-অনুদান চান না। ছেলেসহ শহীদদের হত্যার বিচার চান। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাদের ছেলে আন্দোলনে গিয়ে শহীদ হয়েছেন, সে বৈষম্য যাতে দূর হয় এবং ছেলের রক্ত যেন বৃথা না যায়।

এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।