ময়মনসিংহ: স্বাধীনতা সংগ্রামে ময়মনসিংহের রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে ময়মনসিংহের অধ্যায় বীরত্বগাঁথার।
ওইদিনই ইপিআর ক্যাম্পে ফায়ার হয়। রাতব্যাপী এ যুদ্ধে ইপিআর ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর কমর আব্বাসসহ ১২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ইপিআর সদস্য শহীদ হন। ১৯ জন আত্মসমর্পণ করেন। শহীদ হন দেলোয়ার, আনোয়ার, আবু তাহেরসহ সাত বাঙালি সদস্য।
ময়মনসিংহের মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের যুদ্ধই ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম যুদ্ধ। এ সময়টাতে এসে কিছুদিনের জন্য ময়মনসিংহ স্বাধীনতার স্বাদ নেয়।
‘ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহাসিক নিদর্শন’ গ্রন্থে ইতিহাসবিদ দরজি আব্দুল ওয়াহাব লিখেছেন, ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ময়মনসিংহ মোটামুটি একটি স্বাধীনতার স্বাদ পায়। এরপর এটি শত্রুসেনাদের দখলে চলে আসে।
খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের যুদ্ধে সাধারণ সৈনিকরাই মূলত যুদ্ধ চালান। তাদের জীবনবাজি নেতৃত্বেই পাকিরা পরাজয় বরণ করে। এখানে স্থানীয় ছাত্র-জনতার ভূমিকার রয়েছে বীরত্বগাঁথা ইতিহাস।
বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক বিমল কান্তি দে ‘ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধ: ইতিহাসের সূচিতপত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ময়মনসিংহের বেশিরভাগ অংশ ছিলো ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই ময়মনসিংহে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে পরদিন ২৭ মার্চ রাত ১২টা থেকে ২৮ মার্চ সকাল পর্যন্ত ১৮ ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় ময়মনসিংহের নাম ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আশিক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে ২৭ মার্চ মধ্যরাতের যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ হারুন। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ময়মনসিংহের অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম এখানকার কৃতী সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বের প্রভাব ছিলো অনেক বেশি।
মূলত ০৭ মার্চের পর ময়মনসিংহের সব মহকুমা, থানা থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলেও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু হয়।
জানা যায়, সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার পোড়াকান্দুলিয়া বিদ্যালয় মাঠেও প্রতিদিন বিকেলে শত শত লোক মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতেন। বাঁশের লাঠি, কাঠের বন্দুক, রাম দা, বর্শা নিয়ে লোকজন কুচকাওয়াজ এবং হামাগুড়ি দিয়ে চলা শিখতো।
গ্রাম পর্যায়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন বলে জানান মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আশিক চৌধুরী।
এপ্রিল মাসের পর থেকেই রাজাকার, আলবদররা শান্তি কমিটি গঠন করে বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, ধর্ষণ, গণহত্যা চালায়। ময়মনসিংহ নগরীর ব্রহ্মপুত্র নদছোঁয়া জেলা পরিষদের ডাকবাংলো ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ডাকবাংলোর পেছনে বধ্যভূমিতে সৃষ্ট গণহত্যাযজ্ঞে হাজার হাজার মানুষ শহীদ হয়। ওই সময় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ছিলো রক্তে লাল।
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রাশেদুজ্জামান পবিত্র ‘অনন্য গৌরবের উত্তরাধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধে লেখেন, একাত্তরের ২১ এপ্রিল ময়মনসিংহ ছিলো শত্রুমুক্ত এলাকা।
ত্রাস সৃষ্টি করতে ওইসময় কৌশল হিসেবে বিমান হামলা চালানো হয়। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ময়মনসিংহ অঞ্চল মুক্তি বাহিনীর দখলে ছিলো। ডিসেম্বরের শুরুতেই পাকিরা বুঝতে পারে, তাদের পরাজয় নিশ্চিত।
১১ নম্বর সেক্টরাধীন ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য ও বীরত্বগাঁথায় অনেকের নাম জড়িত। এর মধ্যে ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর আব্দুল হাসিম, শামসুল ইসলাম, তোফাজ্জল হোসেন, এ.এফ.এম. নাজমুল হক তারা, সেলিম সাজ্জাদ, নাজিম উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সংকেত ছিলো ঐতিহাসিক তেলিখালি যুদ্ধ। মূলত ০৩ নভেম্বর সেই সম্মুখযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শত্রুদের পতন শুরু হয়।
০৭ ডিসেম্বর থেকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা মুক্ত হতে শুরু করে। এর ঠিক তিনদিন পর ১০ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ময়মনসিংহ। বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক বিমল কান্তি দে এ দিনটিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় স্মরণি হিসেবে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬
এমএএএম/এসএনএস