ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

একাত্তর

শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালি স্মারক

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০১৭
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালি স্মারক শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা

রাজশাহী: ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল  স্মৃতি সংরক্ষণাগারের এক অনন্য নাম। কেবল তাই নয়, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক নানান স্মৃতিকে ধারণ করে রেখেছে এই সংগ্রহশালা। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান ও ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যারা গবেষণা করতে চান তাদের কাছে এটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা পাঠাগার।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’ দেশের সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বর্ণালি স্মারক হিসেবে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সংগ্রহশালাটি।

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা নতুন প্রজন্মকে জানানোই এই সংগ্রহশালার মূল উদ্দেশ্য। তাই এটি এখন দেশের মুক্তিযুদ্ধের এক দুর্লভ সংগ্রহশালা হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত।

প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রামের তথ্য যত্ন সহকারে আজও সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এখানে। মতিহারের সবুজের সমরোহে আচ্ছাদিত এই সংগ্রশালাটি তাই দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থানও বটে।

অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শহীদ মিনার এলাকা। এখানেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বহনকারী এই সংগ্রহশালা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান গেটে নেমে সামনে তাকালেই দেখা যাবে প্রশাসনিক ভবন। প্রশাসন ভবন থেকে ডান দিকে দুই মিনিট হাঁটলেই দেখতে পাওয়া যাবে শহীদ মিনার। এর পাশেই অবস্থিত এ শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি চমৎকার স্থাপত্য নৈপূণ্যে সমৃদ্ধ। এখানে মোট ছয় হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের তিনটি গ্যালারি রয়েছে। খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সংগ্রহশালাটি যাত্রা শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে এটি সংগ্রহের দিক থেকে সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়েছে। এতে স্থান পেয়েছে ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন চিত্রকর্ম, দলিল-দস্তাবেজ, আলোকচিত্র, জামা, জুব্বা, কোট, ঘড়ি, পোশাক, টুপি, কলমসহ বিভিন্ন দুর্লভ সংগ্রহ।

শিল্পী ফণীন্দ্রনাথ রায়ের নির্মিত শহীদ মিনারের মুক্তমঞ্চের গ্রিন রুমেই গড়ে উঠে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সংগ্রহশালাটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। একই বছরের ৬ মার্চ তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা আবুল ফজল সংগ্রহশালার প্রথম উদ্বোধন করেন। নির্ধারিত স্থান না থাকায় বছরের বিশেষ দিনগুলোতে এটা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হতো। এরপর ১৯৮৯ সালের ২২ মার্চ রাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ আহমদ সংগ্রহশালার মূল ভবনের ভিত্তিপ্রস্ত স্থাপন করেন। ছয় হাজার ৬০০ বর্গফুট এলাকায় তিনটি গ্যালারিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সংগ্রহশালাটি।  

প্রথম গ্যালারিতে ৫৯টি আলোকচিত্র, ৬টি প্রতিকৃতি, ২টি কোলাজ, ৮টি শিল্পকর্ম, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৭টি, ভাস্কর্য ১টি, ডায়েরি ও অন্যান্য পাণ্ডলিপি ৪টি এবং বাঁধাইকৃত ২টি আলোকচিত্র রয়েছে। এখানে রয়েছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহীতে (রাজশাহী কলেজ হোস্টেল গেটে) নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের বাধাইকরা আলোকচিত্র, আমতলার সভা, কালো পতাকা উত্তোলন ও মিছিল, ১৯৫২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি, নগ্নপদ মিছিল; ৫৩-র শহীদ মিনার; ’৬৯-র গণবিক্ষোভের মুখে পুলিশ বাহিনী; ’৬৯-র বিক্ষুব্ধ জনতা ও ব্যারিকেড; শহীদ আসাদ, শহীদ মতিউর, শহীদ রফিক, শহীদ বরকত, শহীদ সালাম ও শহীদ শামসুজ্জোহার প্রতিকৃতি; ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলের অগ্রভাগে শামসুজ্জোহা; ৬৯-এ রাবি শিকদের মিছিল, গুলিবিদ্ধ-হাসপাতালে মৃত-কফিনে শায়িত ড. জোহার ছবি। এছাড়া প্রখ্যাত শিল্পী মোস্তফা মনওয়ারের শিল্পকর্ম, সুজা হায়দারের বর্ণমালা, আবু তাহেরের অসহায় আত্মা, উত্তম দের কোলাজ ‘মুক্তিযোদ্ধার শার্ট’, প্রণব দাসের ভাস্কর্য ‘আর্তনাদ’ আছে এ শহীদ স্মতি সংগ্রশালায়।

দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১০৮টি আলোকচিত্র, ৩৫টি প্রতিকৃতি, ৯টি শিল্পকর্ম, ১৯টি বাঁধাইকরা আলোকচিত্র, ৩টি ভাস্কর্য, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৯৯টি এবং ৫টি ডায়েরি।  

এছাড়া স্বাধীনতাযুদ্ধের ১১ জন সেক্টর কমান্ডার, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, জাতীয় ৪ নেতা এবং রাবির শহীদ শিক্ষকদের প্রতিকৃতি; বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ; স্বাধীনতার ঘোষণা-বাণীর প্রতিলিপি, মুজিবনগরে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র, ঢাকার রাজপথ, ’৭১-র গণবিক্ষোভ, সংগ্রামী জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ, ’৭১-র ছাত্রী নিগ্রহ, ধর্ষিত মাতা-জায়া, গণহত্যা, ২৫ মার্চ ঢাকার রাজপথ, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলের চুক্তিপত্র; মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার; শিল্পীদের আঁকা ছবি, ভাস্কর্য; শহীদদের পোশাক ও ব্যবহৃত জিনিসপত্র; অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান চৌধুরী এবং সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ডায়েরি ও পাণ্ডুলিপি; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজশাহীর শহীদদের বিভিন্ন আলোকচিত্র।

তৃতীয় গ্যালারিতে আছে ১১২টি আলোকচিত্র, ১টি প্রতিকৃতি, ১১টি শিল্পকর্ম, ১টি বাঁধাইকরা আলোকচিত্র, ৬টি ভাস্কর্য, ৪০টি ডায়েরি-পাণ্ডুলিপি, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু ৫৬টি।  

শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দেশের প্রথম শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি দর্শন করতে প্রতিদিন শতাধিক দর্শনার্থী আসেন। বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা ও শহীদ মিনার কমপ্লেক্স সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি আছে। রাবি উপাচার্য হলেন এই কমিটির সভাপতি।

শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার কিউরেটর অধ্যাপক ড. মো. সফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, 'আমি মনে করি শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সে উদ্দেশ্য পূরণে সম্পূর্ণ সফল হয়েছে। এখানে প্রতিদিন প্রায় আড়াইশ দর্শনার্থী আসেন। তবে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের মত বিশেষ দিনগুলোতে হাজার হাজার দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। সংগ্রহশালায় ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহের সংগ্রহও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন-সংগ্রাম, পারিবারিক ও রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন সময়ের প্রায় ৭৫টি দুর্লভ ছবির কাজ চলছে। যা শিগগিরই আমাদের গ্যালারিতে টাঙানো হবে'।  

বাংলাদেশ সময়: ০০৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৭
এসএস/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।