নওয়াপাড়া (যশোর) থেকে: যে দূরন্ত মেয়েডারে চোখে চোখে রাখতি হাঁপায়ে উঠিচি, সে যে এতো সম্মান এইনে দেবে স্বপ্নেও ভাবতি পারিনি। তখন ওরে অনেক বকিচি।
কথা বলতে বলতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে করিমন নেছার। তিনি জলকন্যা খ্যাত মাহফুজা আক্তার শিলার মা। যার সন্তান বাংলাদেশকে নতুন করে চিনিয়েছে বিশ্ব দরবারে। যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বে।
শৈশবের দূরন্ত মেয়েটির কথা বলতে গিয়ে বারবার থামছিলেন মা। ‘যে খেলায় নামতো তাতেই প্রথম হতো। একবারতো কাদের স্যার (নওয়াপাড়া সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক) মাইকিং করে আমারে স্কুলে ডাকলেন।
আমি গেলি প্রধান শিক্ষক বলেছিলেন, ওকে একটু নিয়ে যান। আমরা আর তাকে আটকাতে পারছি না। সব খেলায় নামতে চাইছে। এরই মধ্যে চারটি খেলায় প্রথম হয়েছে। আর নামতে দিতে পারছি না।
‘আমি যেয়ে ওরে ধরে এনেছিলাম। সন্ধ্যায় আবার পালায়ে গিয়ে জারি গান প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তাতেও প্রথম হয় শিলা। ’
করিমন নেছা বলেন, ছোটবেলায় চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যেতো। সারা গ্রাম খুঁজে পাওয়া যেতো না। দেখা যেতো পুকুরি সাঁতার কাটতিছে। পুকুরি একবার নামলি আর উঠতি চাইতো না। স্কুলের বেলা গড়ায়ে গেলিও জোর করে তুলে আনতি হতো।
বিভিন্ন খেলা প্রথম হইয়ে মেডেল নিয়ে আসতো। কিন্তু করিমন নেছা কোনো দিনই গুরুত্ব দিতেন না। বলতেন রেখে দে। কথা বলতে বলতেই বড় মেয়েকে নির্দেশ দিলেন মেডেলগুলো নিয়ে আসার জন্য।
ছোট্ট একটি কাপড়ের ব্যাগ (খনিকটা ঝুলি টাইপের) নিয়ে এলো মেয়েটি। মেডেলগুলো যখন বের করছিলেন তখন মনে হচ্ছিলো যেনো পাড়ার কোনো ছোট স্পোর্টসের দোকানে এসেছি। বাহারি ডিজাইন, বাহারি রঙের সব মেডেল মেলে ধরছেন দেখানোর জন্য। সবগুলোতেই জলকন্যা শিলার নাম খোদাই করা- শুধু এটুকু পার্থক্য। পরিমাণ সত্যিই অনুমান করার মতো নয়। মনে হলো ওজন তিন কেজি পেরিয়ে যাবে।
স্মৃতি নাকি বেদনার হয়। এক্ষেত্রেও তাই হলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, কতগুলো পুরস্কার পেয়েছে সংখ্যা বলতে পারবো না। অভাবের কারণে একটা স্বর্ণপদক বিক্রি করে দিতি বাধ্য হয়েছি। মেয়েডা কি পরিমাণ সেদিন কেঁন্দেছিলো তা বলে বোঝাতি পারবো না। আজও খুব খারাপ লাগে সে কথা মনে হলি।
অনেকে এখন খবর নিতি আসতেছেন। গতকাল (১০ ফেব্রুয়ারি) ডিসি সাহেব এসেছিলেন খোঁজ নিতি। জানতি চেয়েছিলেন কোনো সমস্যা আছে কিনা। আমরা বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার অনুরোধ করিছি।
করিমন নেছা অকপটে স্বীকার করলেন তার দরিদ্র্যতার কথা। জানালেন, বাড়ির জমিটুকু ছাড়া কোনো আবাদি জমি নেই। গাভী পালন করেন। তা দিয়েই টেনে টুনে চলে যায় সংসার।
দুই ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে শিলা চতুর্থ। বড় ছেলে আলী আহমদ গাজী বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েছে। মেঝ ছেলে হোসেন গাজী একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন।
তৃতীয় সন্তান আফরোজা খাতুনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর পঞ্চম সন্তান মেঘলা আক্তার তোয়া পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে।
জলকন্যার স্কুল শিক্ষিকা লক্ষ্মী রানী দে। তার মুখেও যেনো ছুটছিলো শিলার দূরন্তপনার কথা। বললেন, বর্ষার ফোঁটা মাটিতে পড়লে তাকে আর ক্লাসে আটকানো যেতো না। বল নিয়ে ছুটে যেতো মাঠে। খুব ছুটতে পারে সে। শিলা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। তাকে হাতে ধরে ক খ শিখিয়েছি। এটা আমার শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
জলকন্যাকে নিয়ে সবাই যে মেতে রয়েছে তা পা রেখেই অনুমান হলো। সর্বত্রই এখন শিলার বন্দনা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো মাঝ বয়সী তিনজন লোক বিশাল সাইজের একটি ডিজিটাল পথ সাইনবোর্ড নির্দেশক টাঙাচ্ছিলেন। যাতে শোভা পাচ্ছে জলকন্যার পদক জড়ানো ছবি। আর শিলার নাম ও বিশাল অ্যারো মার্ক। মাঝবয়সী লোকগুলোর চোখে-মুখে খুশির ঝিলিক। যেনো বিশাল একটি দায় তারা সারতে সক্ষম হলেন।
ব্যানার টাঙানোর কারণ জানতে চাইলে একজন বলে উঠলেন, ‘শিলা দেশের জন্য সুনাম বইয়ে আনিচে। আর আমরা তার জন্য এতটুকু করবো না তা-কি হয়। ’
প্রধান সড়ক থেকে বাড়িতে যাওয়ার জন্য কোনো সড়ক নেই। একটি সরু আইলের মতো। দু’জন লোকের বেশি পাশাপাশি হাঁটাও সম্ভব নয়। পৌরসভা তাকে হেরিংবন করে দিয়েছে।
খুলনা-যশোর মহাসড়ক থেকে মাত্র ৫ গজ দূরে জলকন্যার বাড়ি। প্রধান সড়ক থেকে একটি পাকা রাস্তা নেমে গেছে পশ্চিমে। সেই পথ ধরে খানকা শরীফ পর্যন্ত গেলে নজরে পড়বে নতুন পথ নির্দেশকটি।
সর্বত্রই যেনো শিলার জয়গান। শিলার মতো দেখা দেখি আরও অনেক ক্ষুদে সাঁতারু এই গ্রামে তৈরি হচ্ছে, যারা জেলার সীমানা পেরিয়ে বিভাগে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। নওয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তাই সাঁতার অন্যতম ইভেন্ট হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকে।
স্কুলের নিজস্ব পুকুর নেই। তাই মোকসেদ আলী মোল্লার পুকুরের দিকে চেয়ে থাকতে হয় বলে জানালেন সহকারী শিক্ষক অহিদুল ইসলাম।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৬
এসআই/এএ