যশোর থেকে ফিরে: ঘুরতে যাওয়ার জন্য কি নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যের প্রয়োজন আছে! এমন প্রশ্নই মনে মধ্যে উঁকিবুঁকি করছিল যশোর থেকে বেনাপোল যাওয়ার পথে।
একটির চেয়ে অপরটির সৌন্দর্য ভিন্ন ও কমনীয়।
পথের দু’ধারে সারিসারি বৃক্ষ। তাতে ঠাঁই করে নিয়েছে নানা রকম গাছ-গাছালি। বৃহদাকার গাছগুলোর শাখা-প্রশাখা অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছাতার মতো শেড তৈরি করেছে। বড় গাছের ফাঁকে ফাঁকে অড়হর ঝোপ ছেয়ে গেছে ফুলে ফুলে।
দেখলে মনে হবে কোনো মহামান্য অতিথিকে বরণ করতে পুরো রাস্তা ফুল দিয়ে সাজানো। কোথাও আবার খানিকটা টানেলের মতো। বিস্তীর্ণ মাঠ আচ্ছাদিত সরিষার হলুদ ফুলে। ফুলের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা মৌমাছি, ফড়িং ও প্রজাতির দল। অবিরাম ছুটে চলছে একফুল থেকে অন্যফুলে। বাদ যায়নি ছোট্ট টুনটুনি পাখিও। বুক বরাবর উঁচু রাই সরিষা ক্ষেতে তিড়িং বিড়িং করে বেড়াচ্ছে নেচে।
সরিষা ক্ষেতের আইলে সারি সারি খেজুর গাছ। ছোট-বড় গাছগুলো ছেঁটে মাটির কলস ঝুলিয়ে দিয়েছেন গাছি। রসের স্বাদ নিতে ছুটে আসছেন অনেকেই। গাছি কলস নিয়ে নামতেই চুমুকেই নিঃশেষ করে দিচ্ছেন কলস ভর্তি রস। আবার কেউ পুরো কলস নিয়ে যাচ্ছেন পায়েস, পিঠার জন্য।
শুধু কি সারিষা ক্ষেতে সীমাবদ্ধ সৌন্দর্য! তেমনটি ভাবার সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে রয়েছে বিঘার পর বিঘা আলু ক্ষেত। তীরের মতো সোজা আলু ক্ষেতের লাইনগুলো, দেখতে ঠিক পাতাবাহারের বাগানের মতো। কোথাও কোথাও আবার রসুন, পেঁয়াজের ক্ষেত। তারও ঠাঁট কম না। সুতো দিয়ে একটি একটি করে কাঠি দিয়ে যেভাবে মালা তৈরি হয়, এখানে রসুন- পেঁয়াজের কুশিগুলো তেমনি মালার মতো করে সাজানো।
কোথাও কোথাও পুরো জমি লাল রঙে রাঙা। এগিয়ে গেলেই মোহনীয় করে তুলবে আপনার মনকে। শাক ক্ষেতগুলো যেনো নরসুন্দর দিয়ে ছাঁটা। রয়েছে মসুরের ক্ষেত। মসুর ক্ষেতের মধ্যেই কোথাও দেখা মিলবে ধনে পাতা ও তিশির।
ফুলময় মাঠের ভেতর দিয়ে মেঠোপথ পৌঁছে গেছে দূরের গাঁয়ে। সেখানে কৃষক পরিবারের বাস। তারা ট্যাপের পানির জন্য হা করে বসে থাকেন না। প্রয়োজন হলেই কলের হাতল চেপে তুলে আনেন সুপেয় পানি। অদ্ভুত বিষয়, শীতের দিনে মেলে কুসুম গরম পানি। আবার গরমের সময় পুরাই বিপরীত। পাওয়া যাবে প্রাণ জুড়ানো শীতল পানির পরশ।
এঁকে বেঁকে বয়ে চলেছে ছোট নদী। তাতে ওত পেতে রয়েছে কানি বক। দৃষ্টি নিবদ্ধ পানিতে।
সকালের দিকে তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তখন শীতের তীব্রতাও কিছুটা কমতে শুরু করেছে। কৃষকরা কোদাল হাতে নেমেছেন আলু ক্ষেতের পরিচর্যার জন্য। গাছগুলোর গোড়ায় মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কারণ এই শেকড়ের ডগায় গজাবে বাঙালির পাতের অন্যতম তরকারির উৎস আলু।
শুধু কি খাদ্য শষ্যের মাঠ, এখানেই দেখা মিলবে রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, গাঁদা, বাহারি রঙের গোলাপসহ নানান প্রজাতির ফুলের ক্ষেত। বিঘার পর বিঘা গোলাপ বাগান নিজেকে উজাড় করে ধরেছে। এখান থেকেই যোগান আসে বাংলার ৮০ শতাংশ ফুল।
পুরো এলাকা সেজেছে অপরূপ সাজে। বিধাতা যেনো নিজ হাতে সাজিয়ে দিয়েছেন যশোরকে। যশোর শহরের সীমানা পেরিয়ে বেনাপোল স্থলবন্দরের দিকে এগুতে থাকলেই চোখে পড়বে এমন দৃশ্য। বিশেষ করে গদখালী এলাকা বেশি বৈচিত্র্যময়।
সফরসঙ্গী ছিলেন বাংলানিউজের খুলনা ব্যুরো এডিটর মাহবুবুর রহমান মুন্না। পথের সৌন্দর্য নিয়ে কথা উঠতেই বললেন, শহরে থাকেন এমন অনেক ছেলে-মেয়ে এসবের সঙ্গে পরিচিত না। তারা হয়তো সরিষা তেল খেয়েছেন। কিন্তু কোনোদিনই সরিষা ক্ষেত দেখেননি, কোনো ধারণাও নেই।
এসব শিশুদের বাংলার পথ ঘাট ঘুরিয়ে দেখানো প্রয়োজন। না হলে হয়তো জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে তারা বিশ্বাস করতে চাইবেন না। কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেবেন।
**‘অর্জন সামান্য’
** বাগেরহাট ভায়া সুন্দরবন, এখনই সময়
** গ্রাম-সুন্দরবনের সেফগার্ড ভোলা নদী (ভিডিও)
** খেজুর রসের গন্ধে মাতাল!
** কুসংস্কারে ভরা দীঘি সম্ভাবনায় ঠাসা
** বাগেরহাট ডিসির কষ্ট ও বাস্তবতা
** চিত্রায় প্লেনের ছোঁয়া
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৬
এসআই/এএ