ফেনী থেকে আমার এক সহকর্মী আর তার ছোটভাইসহ আমরা তিনজন গিয়েছিলাম এবার। ঈদুল আজহার সময় হওয়ায় প্রায় তিনগুণ বেশি ভাড়া দিয়েই বাসে চড়তে হয়েছিল।
ব্রিজের নিচে গিয়ে একটি অটোরিকশায় উঠে পড়লাম ভাড়া নির্ধারিত হলো জনপ্রতি ২৫ টাকায়। চালক জানালেন, সীতাকুন্ড বাজার থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বে চন্দ্রনাথ পাহাড়। এ পথে আমি প্রথম। গেল বার উঠেছিলাম অন্যপথে। দূরত্ব এতো কম আগে জানলে পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যেত কিন্তু বিপত্তি আমাদের সময়ের অভাব। অটোরিকশায় যেতে যেতেই আমরা দেখছিলাম সীতাকুন্ডের সৌন্দর্য। চন্দ্রনাথ পাহাড় শ্রেণীভুক্ত ছোট পাহাড়গুলো ব্যাসকুন্ড থেকে শুরু হয়েছে। যেতে যেতে চোখে পড়লো হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে মন্দির এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাস্তায় চোখে পড়লো নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এরা ত্রিপুরা নামে পরিচিত এবং এখানে তাদের কিছু গ্রামও আছে।
এসব দেখতে দেখতে অটোরিকশা আমাদের নামিয়ে দিল পাহাড়ে ওঠার প্রবেশমুখে। ভাড়া পরিশোধ করে কিছুদূর হাঁটার পর চোখে পড়লো চিকন আনুমানিক দুই-তিন হাত করে কাটা বাঁশ থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কাছে গেলে দোকানি ইব্রহিম জানালেন, পাহাড়ে উঠতে এ বাঁশের প্রয়োজন হবে। আমরাও চিন্তা করলাম লাগবে যখন নিয়ে নেই। প্রতি পিস ২০ টাকা। তবে পাহাড় থেকে ফেরার পথে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দেওয়া গেলে ১০ টাকা করে রিটার্ন করবে। দোকানি উপরে উঠার আগে পানি নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিলেন। যথারীতি দু’ লিটার পানি কিনে আমরা হাঁটতে শুরু করি।
কিছুটা হাঁটার পর চোখে পড়লো একটা মন্দির। বেশ বড়সড়, বেশ ব্যস্ত মন্দিরটা। একজন জানালেন, মন্দিরে ওপাশের পথটি ধরেই আমাদের যেতে হবে। তার পরামর্শে আমরা এগোতে লাগলাম। সেদিন বৃষ্টির কারণে পথ কাঁদা আর পিচ্ছিল হয়েছিল। তাই বেশ সতর্কতার সঙ্গেই পা ফেলতে হচ্ছিল। আনুমানিক দু’শ ফুট ওঠার পর একটা দোকানে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতে হলো। একটা কথা বলে রাখা দরকার এসব দোকানে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দেশীয় কলা পাওয়া যায়। বেশ মিষ্টি স্বাদের এসব কলা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে শক্তির জোগান দেয়।
এরপর আমরা আবার পাহাড়ি পথ বাইতে থাকি। উঠতে উঠতে পাহাড়ের যত গভীরে যাচ্ছি চোখে পড়লো জুমক্ষেত। দেখে বোঝা গেল অল্প কিছুদিন আগেই ধান কাটা হয়েছে এখন বিভিন্ন সবজি ও ফলের গাছ রয়েছে।
আরেকটা কথা বলে রাখা দরকার। পাহাড়ে ওঠার পথে পথে শুধু একটি মাত্র ঝর্ণা দেখতে পাওয়া যায়, এখান থেকে পাহাড়ে ওঠার পথ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, ডানদিকের রাস্তা প্রায় পুরোটাই সিঁড়ি এবং বেশ খাড়া, আর বামদিকের রাস্তাটি পাহাড়ি পথ। মাঝে মাঝে কিছু ভাঙা সিঁড়ি আছে। মনে রাখতে হবে বাম দিকের পথ দিয়ে ওঠা সহজ আর ডানদিকের সিঁড়ির পথ দিয়ে নামা সহজ। এ জায়গায় এসে ভুল করলে কিন্তু অতিরিক্ত ভোগান্তি পোহাতে হবে।
আমরা যখন উঠছিলাম তখন বেলা ১১টা। ঘণ্টাখানেক আগে বৃষ্টি হওয়ায় বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া গাছের পাতা পরিষ্কার, সতেজ পাতা চোখের বেশ আরাম দিয়েছিল। মনে হয়েছে পাহাড়টা যেন পূর্ণ যৌবনা রুপবতী। এই বৃষ্টির সময় পাহাড়ে ওঠা বিপদজক হলেও চারপাশের পরিবেশটা বেশ ভালো লাগছিল।
প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর চোখে পড়বে একটি মন্দির। নতুন কেউ হলে ভেবে নিতে পারেন এটিই বোধ হয় চন্দ্রনাথের মন্দির এবং সর্বোচ্চ চূড়া। কিন্তু না আরও আধা ঘণ্টাখানেক হাঁটতে হবে চূড়ায় উঠতে হলে। আর এরপরেই দেখা মিলবে চন্দ্রনাথ মন্দিরের। আমরা যথারীতি আরও ২০ মিনিট হাঁটার পর চন্দ্রনাথ মন্দিরের দেখা পাই। এত দূর পথ পাড়ি দিয়ে চূড়ায় উঠেই যেন শান্তি। প্রায় ১১শ’ ফুট উপরে মন্দির প্রাঙ্গণেই পাওয়া যাচ্ছে কচি নারকেলের ডাব আর দেশি কলা। ক্লান্ত শরীর খেতে চাইলো।
মন্দিরের বারান্দায় উঠে নিচের দিকে তাকাতেই দেখি অন্য রূপ। নিজের জনপদের বাড়িঘরগুলো কত ছোট ছোট। দূরে সুবিশাল সাগরের অথৈই জল। মনে হলো আমরা যেন সব জয় করে ফেলেছি। কিছু মানুষ ততক্ষণে মন্দিরে পূজা দিচ্ছিল। মন্দিরে ঈশ্বরের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নারীরা। আবার কেউ কেউ মন্দিরের পাশের গাছে সুতো বাঁধছেন। পাহাড় চূড়ার এ তীর্থস্থানে ঈশ্বরের কাছে মানুষগুলো সুখ-শান্তি প্রার্থনা করছিলেন।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা ও শৃঙ্গ
সীতাকুন্ড পাহাড় হিমালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলীয় অংশ। এই পাহাড়টি হিমালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক ঘুরে ভারতের আসাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্য দিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে মিশেছে। চট্টগ্রাম অংশে ফেনী নদী থেকে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৭০ কিলোমিটার। এই পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত হয়েছে সীতাকুন্ড ইকো পার্ক। সীতাকুন্ড শহরের পূর্বে অবস্থিত চন্দ্রনাথ শৃঙ্গ প্রায় ১০২০ ফুট অথবা (৩১০ মিটার) উঁচু এবং চট্টগ্রাম জেলার সর্বোচ্চ স্থান। (সূত্র-উইকিপিডিয়া)
ঝর্ণা/জলপ্রপাত
এখানে রয়েছে সহস্রধারা আর সুপ্তধারা নামের দু’টি জলপ্রপাত। মীরসরাই অংশে রয়েছে খৈয়াছড়া, হরিণমারা, হাটুভাঙ্গা, নাপিত্তাছড়া, বাঘবিয়ানী, বোয়ালিয়া, অমরমানিক্যসহ আরও অনেক ঝর্ণা ও জলপ্রপাত। পূর্বদিকে এই পাহাড় থেকে উৎসারিত হয়েছে কয়েকটি ঝর্ণা যা হালদা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। এর মাঝে গজারিয়া, বারমাসিয়া, ফটিকছড়ি, হারিয়ালছড়ি এবং বোয়ালিয়া অন্যতম। পশ্চিম দিকে মহামায়া, মিঠাছড়াসহ আরও কয়েকটি ছড়া ও ঝর্ণা বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
যেতে হলে
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের এসি, নন এসি সব বাসই সীতাকুন্ডে থামে। এছাড়া ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ‘ঢাকা মেইল’ সীতাকুন্ডে থামে, এটি ঢাকা থেকে ছাড়ে রাত ১১টায় এবং সীতাকুন্ডে পৌঁছে পরদিন সকাল ৬.৩০ থেকে ৭টায়। সীতাকুন্ড বাজার থেকে চার কিলোমিটার পূর্বে। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়, আবার রিকশা কিংবা অটোরিকশায় করেও যাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম থেকে আসতে হলে শহরের অলঙ্কার অথবা যেখান থেকে বাস ছাড়ে সেখান থেকে সীতাকুন্ড নেমে পূর্ব নির্দেশিত পথে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৮
এসএইচডি/আরআর