দিন ৭
রাজারহাট (কুড়িগ্রাম)- পীরগাছা (রংপুর)-জালালগঞ্জ (রংপুর) = ৪১.৯৩ কি. মি.
টিনের গায়ে গরুর গা ঘষার খচমচ শব্দে ঘুমটা ভাঙলো। যে ঘরটায় রাতে শুয়েছি, তার হাত দশেক দূরেই টিনের তৈরি গোয়াল ঘর।
চড়াইখোলা ছাড়াতেই রেললাইনের দিকটায় সারবাঁধা ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। ধানক্ষেতের মধ্যে এদিকে মাছের প্রজেক্ট আছে অনেক। এরকমই এক পুকুরে কুয়ো থেকে লোকে যেভাবে দড়ি বেঁধে বালতি ফেলে ঠিক সেভাবেই ডেকচির মাথায় দড়ি বেঁধে পানি তুলতে দেখলাম। দারুণ ইনোভেশন! এইসব ছোটখাটো ব্যাপারে বাংলাদেশিদের মাথা দারুণ খেলে।
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
রেললাইনের পাশে রোদ পোহাতে বসা বুড়োর দলকে ছেড়ে খানিক এগিয়ে যেতেই ইউক্যালিপটাস গাছের স্থলাভিষিক্ত হলো তাল গাছ। এই রাস্তায় সকালের মিঠে রোদে হাঁটতে দারুণ লাগছে। সামান্যতম ক্লান্তিও অনুভূত হচ্ছে না। পথে পড়লো খটমটে নামের এক বাজার। সিংগারডাবডী বাজার। নাম জপতে জপতে খেয়াল করলাম এতক্ষণ সঙ্গে থাকা রেললাইন এবার সঙ্গ ছাড়লো।
কাশেম বাজার নামক কীটনাশকের দোকানে সয়লাব এক বাজার পেরিয়েই চায়না বাজার। নাক বোঁচা জাতি এই দূরের উপজেলাতেও তাদের ছাপ রেখে গেলো কিনা ভাবতে ভাবতেই সকালের নাশতা সারলাম এখানে। একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, এখানের বেশিরভাগ দোকানেই চিনি ছাড়া চা হয় না। আগেই লিকারে ওরা চিনি গুলে রাখে। বাধ্য হয়ে সে-ই গিলছি।
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
কাচারির পাড় থেকে কিছু সময় আবার লালমনিরহাট জেলার সীমানায় ঢুকে পড়লাম। নয়টার মধ্যে তিস্তা বাস স্ট্যান্ড। দু’দিন আগে তিস্তা পার হয়েছিলাম রেল সেতু দিয়ে। আজ ঠিক করলাম সড়ক সেতু দিয়েই ওপারে যাবো। টোল প্লাজা শুনলেই যেরকম টিপটপ একটা ব্যাপার চোখে ভাসে, তিস্তার টোল প্লাজা মোটেও সেরকম নয়। দুই ভদ্রলোক টিনের বানানো দুই খুপড়িতে বিরসবদনে একের পর এক টোকেন কেটেই যাচ্ছেন।
টোল প্লাজা পেরিয়ে দুই ধারেই প্রচুর গাছ। ছায়ায় চলতে চলতে সেতুর দোরগোড়ায়। তিস্তার এ পাশটায় পাড় বাঁচাতে বসানো ব্লকগুলোর ওপর জেলা পরিষদের অর্থায়নে নির্মিত কিছু সাদা বেঞ্চ চোখে পড়লো। স্কুলের পোশাক পড়া ছেলে-মেয়েরা বেঞ্চের আশেপাশেই ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
সেতু পেরিয়ে মিনিট কয়েকের মধ্যেই কাউনিয়া বাস স্ট্যান্ড। আজকের দিনের মতো মহাসড়ক ধরে চলা এখানেই শেষ। দিনের বাকি পথটুকু ছোট রাস্তা ধরেই চলতে হবে। ম্যাপে আগেই দেখে রেখেছিলাম জায়গাগুলো। কাউনিয়া থেকে হাতের বামের রাস্তা ধরেছি। এ রাস্তাই আমাকে পৌঁছে দেবে অন্নদানগর হয়ে পীরগাছায়।
মহাসড়কের বাস-ট্রাকের বিকট হর্ণ থেকে কর্ণকুহরকে বাঁচাতে পেরেই শান্তি পাচ্ছিলাম। ধানখেতের মধ্যে মাথা তোলা গংগানারায়ণ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখে থামলাম খানিক। পরেশ বাজার ছাড়িয়ে পেলাম এক সেতু। সাইনবোর্ড বলছে এই সেতু মানস নদীর উপর নির্মিত। মানসপটে অনেক কল্পনা করেও কোনো নদীর ছবি আঁকা গেলো না।
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
নিচে পানির বদলে শুধু ধানখেত। দুই ধারে ধানখেত আর ইউক্যালিপটাস গাছ সঙ্গে নিয়েই চলছি। শিবুকুটির পাড়ার মধ্য দিয়ে এগোতেই অন্নদানগর বাজার। এখানে আছে একটা রেল স্টেশনও। এখান থেকে পীরগাছা বেশ কিছুটা রাস্তা ধরে যাওয়া যায়। আমি বেছে নিলাম রেললাইনের পাশ ঘেঁষা বান্দরবানের পাহাড়ি ট্রেইলের মতো দেখতে মাটির রাস্তাটা। দুই পাশে সবুজ ঘাসের মধ্যে এক ফালি পায়ে চলার মতো রাস্তা। কিছু জায়গায় দুই পা একসঙ্গেও ফেলা যায় না। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজের সমুদ্রে সাদা একটা দাগ টেনে দিয়েছে কেউ। স্থানে স্থানে সাদা দাগ তথা রাস্তা হারিয়ে গেছে ঘন ঘাসের আড়ালে। তখন রেললাইনের পাতই ভরসা ধরে এগুচ্ছি। এত এত গরু-ছাগল চরছে দেখে একে রেললাইন কম, গো-চারণ ক্ষেত্র বেশি বলে ভ্রম হচ্ছিল।
এদিকে অনেক হিন্দু বসতি। মন্দির থেকে শুরু করে ব্রাক্ষণের পৈতা দেখতে দেখতেই পীরগাছার পানে এগিয়ে চলা। চারপাশের ধানখেতের শীষের আগায় দোলা দিতে দিতে ছুটে গেলো ট্রেন। ঝিকঝিক আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই আবার হাঁটা। চলতি পথে থেকে থেকেই লোকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল- ‘বাড়ী কোঠে?’ পীরগাছার কাছাকাছি আসতে সরু ফিতার মতো রাস্তাটা ঘাসের আড়ালে হারাতেই পার্শ্ববর্তী রাস্তায় উঠে গেলাম। শত শত কলাগাছ পেরিয়ে সোয়া একটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম পীরগাছায়। আজ আমার এখানেই রাতে থাকার পরিকল্পনা। তবে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম আজ আরও কিছুদূর এগিয়ে একটা নির্দিষ্ট
জায়গায় শেষ করে পীরগাছায় ফিরে আসবো। কাল শুরু করবো ওই জায়গা থেকেই। এর মূল কারণ পীরগাছা থেকে কালকের গন্তব্য গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর দূরত্ব অনেক। আজ কিছুটা কমিয়ে রাখতে পারলে কাল কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলবে।
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পীরাগছা চৌরাস্তা থেকে সোজা রাস্তাটা ধরলাম, উদ্দেশ্য জালালগঞ্জ। ডোবাভর্তি কচুরিপানা ফুল দেখলাম দুধিয়াবাড়ীতে। এ রাস্তায় দেখা মিলছে প্রচুর টার্কির। সদলবলে নিশ্চিন্তে রাস্তার ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চালুনিয়া পার হয়ে বকশিবাজার যেতেই এবার বামের রাস্তা ধরেই পথ। খানিক সময়ের মধ্যেই ব্যস্ত চৌধুরাণী হাট। আবার ডানে মোড় ঘুরে অল্প যেতেই চোখে পড়লো ছায়া সুনিবিড় দারুণ এক রাস্তা। ধীর পায়ে বটতলী কলেজ বাজার ছাড়াতেই এবার নারিকেল গাছের সারি পথের দুই ধারে। রাস্তার পাশে নারিকেল গাছ চোখে পড়েনি আগে। এসব গাছ ফলন দেওয়া শুরু করলে আমার মতো পথিকদের কী হাল হবে কে জানে!
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
হঠাৎ এক কিশোর আমাকে দেখে বলে উঠলো- ‘আপনি আসছেন এই খবর দেবো গ্রামবাসীকে? উঠান বৈঠক করবেন না আজকে?’
আমি তো থতমত খেলাম রীতিমতো। ভালোমতো কথা বলতেই জানলাম ওই কিশোর আমাকে এনজিও কর্মী ভেবেছে। রাস্তাটা সুন্দর-ছিমছাম হলেও এ দিকটায় দারুণ ঘনবসতি।
মংলাকুটি, কৈকুড়ি বাজার হয়ে জালালগঞ্জ পৌঁছালাম সাড়ে চারটা নাগাদ। আজকের হাঁটা এখানেই শেষ। কালকের দিনের জন্য বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে রাখার তৃপ্তি কাজ করছে মনে। কাল এখান থেকেই শুরু হবে দু’পায়ে চলা। অটোতে আমার আজকের আবাসস্থল পীরগাছায় ফিরতে ফিরতেই ফোন দিলাম বান্ধবী মণির চাচাকে। উনি ঠিকানা দিতেই হাজির হয়ে উনার বাড়ি যখন ঢুকছি তখন সন্ধ্যা হব হব করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০২, ২০২০
এইচএডি/