দিন ৯
পলাশবাড়ী (গাইবান্ধা) - শিবগঞ্জ (বগুড়া) = ৩৮.৫৪ কি. মি.
এই কয়দিন যাত্রাপথে যেখানেই রাত্রিযাপন করেছি, সব কয়টাই ছিল বাড়ি। অদ্যাবধি যাত্রায় এইবারই প্রথম কোনো বাসায় থাকা হলো।
সবুজ ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে আশেপাশের দু-তিনটে বাড়ি থেকে আসা শিউলি ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে যখন মহাসড়কে উঠেছি তখন সবে ভোর সাড়ে ছয়টা। দক্ষিণ বন্দর পার হতেই চোখ আটকালো সারি সারি কলার কাঁদিতে। জায়গাটা কলার একটা অস্থায়ী বাজার। কাঁদি কাঁদি কলা ভ্যানে বোঝাই হয়ে আছে বিক্রির অপেক্ষায়। একটু সামনেই পেলাম ড্রীমল্যান্ড অ্যাডুকেশনাল পার্ক। পড়াশোনাকে থিম করেই নাকি বানানো এই পার্ক। হতভাগা বাচ্চারা পার্কে এসেও শান্তি পাবে না।
পার্ক ছাড়িয়ে অল্প যেতেই এই খোদ গাইবান্ধাতেই দেখা মিলে গেলো বরিশাল ইউনিয়ন পরিষদের। আজকের বেশিরভাগ রাস্তাই মহাসড়ক এন ৫ ধরে। এখানে মহাসড়কের পাশেই ইঞ্চিখানেক নীচুতে ছোট্ট পায়ে হাঁটা পথ পিচ করা আছে। ওই রাস্তা ধরে হাঁটতে তেমন কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। একে একে পার হলাম জুনদহ বাজার, দুবলাগাড়ী। শনপাতা আর কলা গাছে ভরপুর বিশাল এক জায়গা শেষ হতেই পলাশবাড়ী উপজেলার ইতি।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার প্রথম বাজার অবিরামপুরে কোনো বিরাম না দিয়ে কোমরপুরের আগে দেখা হলো কোমরপুর স্কুলের ক্লাস টেনের শিক্ষার্থী অপূর্বর সঙ্গে। ওর প্রিয় বিষয় রসায়ন জেনে আমিই খুশি হলাম। রসায়ন আমারও দারুণ প্রিয় বিষয়। কিলোমিটার খানেক পথ ওর সঙ্গে ইলেকট্রন বিন্যাস, পারমাণবিক সংখ্যা, অরবিট, অরবিটাল নিয়ে গল্প করে ওর স্কুলের কাছে ওকে বিদায় দিলাম। মাঝে জিপিএস সিগন্যাল হারিয়ে কিছু সময় বন্ধ ছিল এন্ডমন্ডো অ্যাপ। সেটা দেখেই মনটা একদফা খারাপ হয়ে গেলো।
আজ সকাল থেকেই যাত্রাপথে ভ্যানে প্রচুর স্কুল শিক্ষার্থীর ভিড় দেখছি। খানিক পরেই মনে পড়লো আজ জেএসসি পরীক্ষা শুরু। রোদে পুড়তে পুড়তে কালিতলা পেরুতেই দৃষ্টিগোচর হলো বিশাল কচুরিপানা ভর্তি পুকুর। ভাটার মোড়ে সওজের সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম- ‘যদি চাই সোনার বাংলা, চাই উন্নতি, সড়কে ওভারলোডের টানুন ইতি। ’
বালুয়াহাট ছাড়িয়েই পড়লো এক নদী। নদীর নাম বাঙ্গালী। নদীর পাড়েই গণকবরের একটা স্মৃতিফলক ও নিহতদের নামের তালিকা চোখে পড়লো। এই মহাসড়কটা ওয়ান ওয়ে হলেও সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে বড় বাজারগুলোতে দেওয়া আছে বিশাল সব রোড ডিভাইডার।
এগারোটা নাগাদ গোবিন্দগঞ্জ এসে প্রথম যে জিনিসে চোখ পড়লো সেটা হলো সিএনজি। গত কয়দিনে ঢাকা-চট্টগ্রামে রাজত্ব কায়েম করা এই বাহনটার দেখাই মেলেনি। বকচর পেরিয়ে দেখা মিললো সারবাঁধা ট্রাকের। আর একইসঙ্গে দুপাশে অনেকগুলা ভাতের হোটেল। বোঝাই যাচ্ছে এই হোটেলগুলো ট্রাক/লরির ড্রাইভারদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়।
অতীত অভিজ্ঞতা বলে এই ধরনের হোটেলের খাবার বেশ সুস্বাদু হয়। এত তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার সারার ইচ্ছে নেই দেখে ওসব হোটেলমুখী হলাম না। ধীরপায়ে চলতে চলতে একসময় ফাঁসিতলা।
অন্যদিন রাস্তায় কিছুটা হলেও গাছের ছায়া ভাগ্যে জোটে। আজ সে কপাল নেই। এক আখ ক্ষেতে কয়েকটা করে আখ এমনভাবে মুড়ে রাখা হয়েছে, প্রথম দর্শনে যেন মনে হয় একটা তিন পেয়ে জানোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। মাজারের একটামাত্র দানবাক্স রাখার জন্য চারপাশে চারটে পিলার দিয়ে বানানো বিচিত্র এক ছাউনি দেখতে দেখতেই চলে এলাম চাঁপড়ীগঞ্জ বাজার। বার্ণার মোড় ছাড়িয়েই শেষ একইসঙ্গে গাইবান্ধা জেলা এবং রংপুর বিভাগের সীমানা। যাত্রা শুরুর নয়দিনের মাথায় একটা বিভাগ পেরুলাম। এখান থেকেই বগুড়া জেলা এবং রাজশাহী বিভাগের সীমানা শুরু।
রহবল বাজার থেকে খানিক এগিয়েই পাকুড়তলা বাজার। এবার মহাসড়ক ছেড়ে ডানে ছোট রাস্তা ধরে পথ। দুপাশে বিশাল সবধান ক্ষেতের মাঝে দেখা পাচ্ছিলাম বিচিত্র সব কাকতাড়ুয়ার। আধা কিলোমিটার মতো এগিয়েই মাটির রাস্তা। ‘বাড়ী কোঠে’ প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক দিতে পারছিলাম। ‘ব্যাগত কি?’-এক পিচ্চির ছুঁড়ে দেওয়া এই প্রশ্নে ভালোই হতভম্ব হলাম। চারিদিকে কলা আর কলাগাছ। এইদিকে এত এত কলা হয় জানা ছিল না। গ্রামের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এক মা আমাকে দেখিয়ে তার পিচ্চিকে বললেন, ওই দ্যাখ সন্ন্যাসী যায়। বিশাল এক কলা খেতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় এক কৃষক সাহস সঞ্চয় করে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘হাউ আর ইউ?’
আমার মুখে বাংলা শুনে ভদ্রলোক যথেষ্ট আহত হলেন বলেই মনে হলো। রথবাড়ি নামক জায়গা থেকে মোকামতলা-জয়পুরহাট সড়কে উঠতেই মাটির রাস্তা পেছনে মিলিয়ে গেলো। খানিক সামনে যেতেই পেলাম শীর্ণকায় করতোয়া নদীর দেখা। মিডল্যান্ড ব্যাংক নামক এক ব্যাংক দেখলাম আমতলী বন্দরে। দেশের আর কোথাও এই নামের ব্যাংক আগেচোখে পড়েনি।
আমতলী থেকে বামে মোড় নিতেই হাটের মুখে পড়লো কারেন্ট বাবার দানবাক্স। করতোয়ার পাড়ের শশ্মান পেরিয়েই ফোন দিলাম ওমর ভাইকে। উনার বাড়িতেই আজ রাতে থাকার ব্যবস্থা। থানা সংলগ্ন উনাদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম মিনিট দশেকের মধ্যেই।
সন্ধ্যার আগেই ওমর ভাইয়ের বন্ধু রাব্বি চলে এলেন গল্প করতে। এক দফা বাড়িতে আড্ডাবাজি করে কানন ভাই ফোন দিতেই শিবগঞ্জ কলেজের মাঠে চলে গেলাম। বগুড়া থেকে দেখা করতে আসা কানন ভাই মহাস্থানগড় থেকে আনা কটকটি ফেরার আগে আমার হস্তগত করে দিয়ে গেলেন।
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
*** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
***পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
***পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
***পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০২০
এইচএডি/