ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ১২
নওগাঁ-দেলুয়াবাড়ী (মান্দা)= ৩৫.৩২ কিমি
শহরের মাঝ বরাবর বয়ে চলা নদী। আর তার দুই তীরে গড়ে ওঠা শহর আমার বেশ লাগে।

ছোট যমুনা নদী তীরের নওগাঁ ঠিক তেমনি একটা শহর। সেলিম ভাইয়ের পাঁচতলার ছোট্ট ছিমছাম ফ্ল্যাটের ভবনটা একদম নদী লাগোয়া। আগের রাতে বেশ আগেভাগেই শুয়ে পড়ায় শেষ রাতেই ঘুম ভাঙলো। ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া দেখে ব্রেড, জ্যাম-জেলি সমেত সকালের নাশতা সেরে খানিক বাদেই ব্যাকপ্যাক কাঁধে আবারো পথে। বিশাল এক খেজুরের দোকান মনোযোগ কাড়লো। হরেক রকমের খেজুর সেখানে। শুধু একটাই পণ্যের এতবড় দোকান এই ভোরবেলাতেই বিকিকিনি শুরু করে দিয়েছে। কাদামাখা পথনওগাঁ এমনিতেই পট্টির শহর৷ কালই বেশ কিছু পট্টির দেখা পেয়েছিলাম। আজ দিনের শুরুতে স্বাগত জানাল চুড়িপট্টি। মান্দার দিকে বেশ ক'ভাবে যাওয়া যায়। আমি ধরলাম দুবলহাটীর রাস্তা। শহরটা এদিকেও বেশ খানিকটা দূর এগিয়েছে। পাটালীর মোড়, লাটা পাড়া হয়ে সাহানাবাগ নামে গোছানো একটা আবাসিক এলাকা পেরুলাম। রাস্তার দু'পাশেই অনেক ঘর-বাড়ি। বেশ ঘনবসতি এদিকে। চকপ্রাণ পার হয়ে তালতলী বাজার। এখান থেকেই গ্রামীণ পরিবেশের শুরু। দু'পাশে বিশাল সব বিল। কুয়াশা তখনো লেপ্টে আছে সবদিকে।
দুবলহাটী অভিমুখের রাস্তাখানিক এগোতেই রাস্তার এক পাশে পাকা সব বেঞ্চিতে বসার ব্যবস্থা। এই জায়গাটা স্থানীয় লোকের কাছে বেশ জনপ্রিয়। পিকনিক পার্টির দৌরাত্ম্যের প্রমাণ হিসেবে এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ওয়ান টাইম প্লেট। এই বিলে আছে প্রচুর পাখি। বক, মাছরাঙা, পানকৌড়ির দেখা মিলছিল সহজেই। বিলেই ভাসমান রেস্টুরেন্ট আছে একটা। নাম ইছা ও ইউছুব ভাসমান রেস্টুরেন্ট। সাইনবোর্ডে লেখা প্রবেশমূল্য ১০ টাকা আর সময় ২০-২৫ মিনিট। রেস্টুরেন্টে প্রবেশমূল্য জিনিসটা বেমানান ঠেকলো। বিশাল এক মৌমাছির চাক পেরিয়ে তালগাছ আর শিশু গাছের সাম্রাজ্যে এসে পড়লাম যেন।

আরো শ'খানেক পাকা বেঞ্চি পেরিয়ে সাড়ে ৮টা নাগাদ দুবলহাটী। বেশ জমজমাট বাজার। এখান থেকে ধরলাম সনলিয়া রোড। কিছুদূর এগোতেই মাটির রাস্তার রাজত্ব। পাশের বিলে মাছ ধরার নানান সরঞ্জাম, প্রস্তুতি দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মাটির রাস্তাটা বেশ এবড়োখেবড়ো। এক জায়গায় পেলাম ভয়াবহ কাদা৷ জুতা হাতে নিয়ে পার হয়ে খানিক যেতেই আবারো একই রকম কাদা৷ এরপর খানিকটা সময় জুতা হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই কালীপুর। এদিকে ভেড়া পালন হয় প্রচুর। কালীপুর ছাড়িয়ে কিছুদূর সামনে যেতেই চোখে পড়লো বেশ ক'টা কালভার্ট। কালভার্ট আছে কিন্তু রাস্তা নেই। পাশে পায়ে হাঁটা পথ। ওপথে খানিক এগিয়ে আমার মাথায় হাত। সামনে আর এগোনোর রাস্তা নেই। রাস্তা কোমর সমান পানির নিচে৷ অথচ গুগল ম্যাপ বলছে রাস্তা ওদিকেই।

মানিকদহ বিলপাশেই মাছ ধরছিলেন জনাদুয়েক লোক। পরিত্রাণের উপায় জিজ্ঞেস করলাম ওদের। বললেন ওপারে যাওয়া যায় নৌকায় করে। তবে নৌকা এখন পাওয়া যাবে না। ভোরের দিকে পাওয়া যায়। আমার তখন শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে চলছে। এই বিশাল পথ ঘুরে যদি এখন আবার দুবলহাটী যাওয়া লাগে, তাহলে আজকের পরিকল্পনার পরি উড়ে গিয়ে কল্পনাটাই শুধু অবশিষ্ট থাকবে। খানিক পিছিয়ে এক চায়ের দোকানের সামনে বসে গেলাম৷ এক কাপ গরম চা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করবো ভেবে চা চাইতেই চায়ের দোকানেই চা পাওয়া গেলো না।  

এর মধ্যেই এক মাঝবয়সী রাজি হয়ে গেলেন ওনার নৌকায় ওদিকের ডাঙা পর্যন্ত উঠিয়ে দিতে। পরের ঘটনাপ্রবাহ হলো সেই কাঠের নৌকা বাঁশের লগি দিয়ে ঠেলে কচুরিপানার বিশাল সব জট ছাড়িয়ে ওপাড়ের ডাঙায় উঠতে ৪৫ মিনিট সময় শেষ। গুগল ম্যাপ দেখে বুঝলাম, এগিয়েছি মাত্র এক কিমি।

মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে নৌকা থেকে নেমে আবিষ্কার করলাম আমার জুতার একপাশ ছিড়ে কোনোরকমে নিজের শেষ অস্তিত্বটুকু বজায় রেখেছে। এই মানিকদহ নামক বিল যথেষ্ট ভোগালো।

ডাঙায় উঠেই সরু মাটির রাস্তা ধরে পথ। অল্প এগিয়েই পড়লো ভীমপুর। দারুণ সব ইক্ষুক্ষেত আছে এদিকটায়। শরীর মোড় থেকে ডানে বেঁকে উঠলাম পাজরভাঙ্গা নামক রাস্তায়। এখান থেকেই শুরু মান্দা উপজেলা। বালুডাঙা ছাড়িয়ে সামনে যেতেই পোলাও চাল হয় যে ধান থেকে, সেই চিনকিনি ক্ষেত বাড়তে থাকলো। কিছুদূর গিয়ে পড়ে গেলাম রাস্তা খোঁড়াখুড়ির মধ্যে। রাস্তায় ফেলা হয়েছে প্রচুর বালু। পা বাঁচিয়ে চলে অযোধ্যাপাড়া হয়ে সতীহাটের কাছে এসে মহাসড়কে। এর মাঝেই আমার ব্যাকপ্যাক দেখে এক লোক জিজ্ঞেস করেছে আমি কীটনাশক কোম্পানির লোক কিনা। মহাসড়ক থেকেই একটা পার্শ্বরাস্তা ঢুকেছে নীলকুঠি নামক একটা জায়গায়। আজকের আবহাওয়া কেমন জানি ম্যাড়মেড়ে। সূর্যটা নিতান্ত অনিচ্ছায় অল্প আলো ছড়াচ্ছে। কেমন তন্দ্রাছন্ন চারপাশ। সড়কের পাশে নেই কোনো গাছ, তার বদলে আছে ইটভাটা। সাতবাড়ীয়া বাজার হয়ে পারইল পেরোতেই আত্রাই নদী পড়লো যাত্রাপথে। অনেকদিন পর উত্তরবঙ্গের একটা নদী দেখে মন ভরলো। পানিতে বেশ ফুলে-ফেঁপে আছে। নেই কোনো চর। মান্দা ফেরিঘাট বাজারে এসে দুপুরের খাবারের এক ফাঁকে জুতাটা সেলাই করে নিলাম।  

পাঁচ টাকার নোটের পেছনে মুদ্রিত কুসুম্বা মসজিদআবার পথচলা শুরু করেই পেলাম শহীদ কামরুজ্জামান টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের নির্মাণাধীন ভবনগুলোর কর্মযজ্ঞ। বিজয়পুর পেরিয়ে এসে হঠাৎ খেয়াল হলো মান্দা ফেরিঘাট থেকে রওয়ানা দেওয়ার পরে এন্ডোমন্ডো অ্যাপটাই চালু করা হলো না। মাঝে পেরিয়ে গেছে ২.৪ কিমি পথ। আজকের দিনটাই কেমন জানি কুফা।

অ্যাপ চালু করে খানিক এগিয়ে ডানের পথ ধরলাম। উদ্দেশ্যে ছোটবেলা থেকে দেখে আসা পাঁচ টাকার নোটের পেছনদিকে মুদ্রিত বিখ্যাত কুসুম্বা মসজিদ দর্শন। সুবিশাল এক দীঘির পাড়ঘেঁষে এর অবস্থান। সাড়ে চারশ বছরের পুরনো এই মসজিদের নাম কুসুম্বা হলেও এলাকার আশপাশের সব দোকানে নাম লেখা কুশুম্বা। পা চালিয়ে হাজি গোবিন্দপুর হয়ে দেলুয়াবাড়ী গিয়ে আজকের দিনের মতো হাঁটা যখন শেষ করলাম তখন ঘড়ির কাঁটা পাঁচ ছুঁই ছুঁই। অটোতে চেপে আবার মান্দা ফেরিঘাটে এসে পেয়ে গেলাম আরিফার শ্বশুরকে। ওনার বাড়িতেই আজকের রাত্রিবাস। ভ্যানে চেপে সাহাপুর পেরিয়ে পিরপালী বাজারের কাছে মাটির তৈরি দারুণ সুন্দর বাড়িটাতে ঢুকতে ঢুকতে ভরসন্ধ্যা।

চলবে...

আরও পড়ুন>>


পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।