ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ২৬
জয়শ্রী বাজার (ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ)-দিরাই পয়েন্ট (সুনামগঞ্জ সদর)- শান্তিগঞ্জ বাজার (সুনামগঞ্জ)= ৪৩.৭ কিমি

পদব্রজে এই ভ্রমণ পরিকল্পনা করার সময়ই এই দিনটা নিয়ে আমি বেশ উত্তেজিত ছিলাম। হাওরকে চর্মচক্ষে এই যাত্রায় কাছ থেকে দেখার এটাই দারুণ সুযোগ।

কালকের হাঁটা শেষ করেছিলাম জয়শ্রী বাজারে। ভোরে বেরিয়ে জয়শ্রী বাজারে এসেই প্রথমে পড়লো ফেরি। গতকালই এই ফেরি দেখে গিয়েছিলাম। ছোট নৌকায় নদী পার হয়েই ওপাড়ে। এখান থেকেই হাওরের শুরু।

অপর পাশে থাকতেই লোকে বলছিল নৌকায় সরাসরি মান্নান ঘাট চলে যেতে। ঘাটে বসা সব লোক একই কথা বললেও এক বুড়ো ভদ্রলোক আমার হাঁটার পরিকল্পনা শুনে বাতলালেন আরেকটা পথ। ওপাড়ে গিয়ে কিলোমিটার খানেক হেঁটে নৌকায় সুখাইড় বাজার গিয়ে ওখান থেকে হেঁটে মান্নান ঘাট যাওয়ার রাস্তা ভালোমতো বুঝিয়ে দিলেন। বুড়োকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সে রাস্তাতেই পা বাড়ালাম।

কাদামাখা পথ।  ছবি: বাংলানিউজ

ওপাড়ে গিয়েই হাঁটু সমান কাদা পার হয়ে সরু একটা মাটির রাস্তা ধরে পথচলা। চলতি পথে এক লোক জিজ্ঞেস করলো আমার গন্তব্য কোথায়। সুখাইড় বাজারের কথা বলতেই জানালেন উনি এইমাত্র এসেছেন সুখাইড় থেকে। নৌকা তাদের নামিয়ে দিয়ে ফিরতি পথ ধরেছেন। এই নৌকা না পেলে আরো ঘণ্টাখানেক বসে থাকতে হবে। ওনার কাছ থেকে মাঝির ফোন নম্বর নিয়ে তৎক্ষণাৎ ফোন দিলাম। মাঝি আমাকে জানালেন গোরস্থানের কাছে অপেক্ষা করতে। ততক্ষণে তিনি নৌকা ঘুরিয়ে আসছেন।

আমি সরু মাটির রাস্তা ধরে হাঁটছি তো হাঁটছিই, গোরস্থান আর পাই না। মাঝি খানিক পর পর ফোন করছেন আর জিজ্ঞেস করছেন আমি কোথায়। খোলা একটা প্রান্তরে অল্প কিছু ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে দাঁড়ানো আমি কীভাবে অবস্থান ব্যাখ্যা করবো সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। অন্ধকারে আলোর রেখার মতো দেখা দিলেন এক স্থানীয় ব্যক্তি। তার কাছ থেকে গোরস্থানের দিশা পেলাম। একটু পরেই নৌকাসমেত পেয়ে গেলাম মাঝিকে। আবারো এক হাঁটু কাদা পেরিয়ে নৌকায়।

মেঠো পথ।  ছবি: বাংলানিউজ

মিনিট বিশেক হাওর চিরে বয়ে চললো নৌকা। সুখাইড় বাজার থেকে হাঁটা শুরু। এখানের রাস্তার বেশিরভাগ অংশই মূলত পানির নিচে থাকে বর্ষার সময়। যেতে যেতেই প্রচুর পানকৌড়ি চোখে পড়ছিল। বিশাল সব ইলেকট্রিকের পোলও শরীরের নিচের অংশ হাওরের পানিতে ডুবিয়ে দিব্যি দণ্ডায়মান। অল্প ক'টা হিজল-করচও চোখ এড়ালো না। হাঁটার রাস্তার অবস্থাও খুব একটা সুবিধের না। বড্ড এবড়ো-খেবড়ো। এ এলাকার বাসিন্দাদের প্রচুর গরু৷ গরু চরাতে যাওয়া ব্যস্ত সমস্ত লোকজনের দেখা পাচ্ছি চলতি পথে। আর হাওরের পানিতে হাঁস আর হাঁস।

এক ছোকরা ইংরেজিতে 'হেই ম্যান' বলে কথা বলা শুরু করে সালাম দিয়ে সরে পড়লো। এতদিনের যাত্রাপথে দেখে আসছিলাম গোবরের খড়ি। আজ চোখে পড়ছে গোবরের চাকতি। যার ভিত্তিটা আবার খড় দিয়ে বানানো। হাঁটার সময় এদিকের ছেলে-বুড়ো সবাই প্রচুর সালাম দিচ্ছে। সালামের উত্তর দিতে দিতেই গোলকপুর বাজার। এর মধ্যেই এন্ডোমন্ডো অ্যাপটা বার দুয়েক বন্ধ হয়ে গেলো। এদিকে নেটওয়ার্কের বেশ ঝামেলা। বাজারের শেষ মাথা থেকে হাতে টানা নৌকা বেয়ে ওপাড়ে মান্নান ঘাটের সংবাদপুর বাজার। এখান থেকেই জামালগঞ্জ উপজেলার শুরু।

প্রচুর টমেটো ক্ষেতের মাঝ দিয়ে পথ চলছি। টিনের বাড়ি হলেও প্রত্যেকটা বাড়িতেই সুন্দর কারুকাজ করা। জামালগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার দু’টি পথ বাতলাচ্ছিল গুগল ম্যাপ। যে জায়গা থেকে মোড় নেওয়ার কথা সেখানে পৌঁছে এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম এদিকের রাস্তা সম্পর্কে। উনি জানালেন এই রাস্তার অনেকাংশই এখনো পানির নিচে। গেলে অনেকবার নৌকাতে পার হওয়া লাগবে। অতএব সেরাস্তা বাদ৷ বড় রাস্তাই ধরতে হলো। বড় রাস্তা ধরে গেলে বেড়ে যাবে আরো ৬ কিমি। অগত্যা সে পথেই পা চালালাম।

হাওরে ইলেকট্রিক পোল।  ছবি: বাংলানিউজ

ভাটি লালপুর থেকেই হাতের বাঁ পাশে সুরমা নদী একেবারে হাতছোঁয়া দুরত্বে। এক বাড়ির সামনে দিয়ে এগোনোর সময় এক মা ভাত খাওয়ানোর সময় তার বাচ্চাকে আমাকে দেখিয়ে বললো ভাত না খেলে এই পাগল ধরে নিয়ে যাবে!

লক্ষীপুরের কাছে মাছ মেরে শুটকি বানানোর জন্য টাঙিয়ে দেওয়া দেখলাম। টানা হেঁটে একে একে পেরোলাম চাঁনপুর, নয়াহালট, নতুন পাড়া। জামালগঞ্জ বাজারের কাছে এসেই এক ভাজাপোড়ার দোকানে বাঁধাকপির বড়া ভাজা হচ্ছে দেখে লোভ সংবরণ করা গেলো না আর। খেতে খেতে দোকানি আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি কোনো অডিটে এসেছি কিনা। জামালগঞ্জ থেকে হাতের ডানের জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জসড়ক ধরলাম।

তেলিয়া লামা পাড়া হয়ে বাঁধ বাজার। রাস্তার দু'পাশে আকাশমণি গাছই বেশি। ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটা ইপিল ইপিল আর ইউক্যালিপটাস৷ ছোট ঘাগটিয়া পার হয়ে কচুরিপানা বোঝাই ভ্যান দেখলাম বেশকিছু। এই পথের পাশেই সুরমা নদী থাকলেও তার দুপাশে স্তূপ করে রাখা বালির জন্য দেখা পাওয়াই মুশকিল। নোয়াগাঁও পারহয়ে আমড়িয়াতে এলাম লালসালুতে মোড়ানো কবর। পাশেই মজিদগোত্রীয় একজনকে উদাসদৃষ্টিতে বসে থাকতে দেখা গেলো।

কারুকাজ করা টিনের বাড়ি।  ছবি: বাংলানিউজ

ধনপুর পার হতে হতে শেষ বিকেল। আজকের দিনের সবচেয়ে ছায়াঘেরা রাস্তাটা মিললো দিনের শেষভাগে এসে। শাখাইতি নামক জায়গা থেকে দুপাশে সঙ্গী হলো বাঁশবাগান। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সীমানা শুরু শাখাইতি উলুতুলু থেকে। এখানেই এক মাঠভর্তি ছেলে-পেলে দেখলাম খেলছে মাঠে। ফুটবল-ক্রিকেট দুই-ই খেলা হচ্ছে অনেকগুলো ছোট দলে ভাগ হয়ে। কামাল বাজার পারহতেই সন্ধ্যা। সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কে উঠলাম কাঠইর বাজার থেকে। খানিকপরেই দিরাই পয়েন্ট। এখান থেকে ডানে এগিয়ে জয়কলস বাজার হয়ে আজকের হাঁটার ইতি টানলাম শান্তিগঞ্জ বাজারে এসে।

সুনামগঞ্জে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা প্রণব'দার সঙ্গে। পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দাদা কাজ করেন এলজিইডিতে। থাকেন সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদ রেস্ট হাউজে। পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের কাছে আসতেই উনি চলে এলেন। পানসীতে ভরপেট খেয়ে তবেই রেস্ট হাউজ অভিমুখে যাত্রা।
চলবে...

আরও পড়ুন...
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।