এখান থেকে ঠিক পঁচিশ কদম এগিয়ে হাতের বাম পাশে তার বাসা। লোকটির হাতে যে মানসিক চিকিৎসকের ঠিকানা আছে এবং কিছুক্ষণ আগেই তিনি পুলিশি জেরা থেকে ছাড়া পেয়েছেন তাও কোনো পথচারীর কিংবা আমার জানার কথা নয়।
সুতরাং, পুলিশ যখন তাকে বলে, আজমত সাহেব আপনি দ্রুত মানসিক রোগের ডাক্তার দেখান, তখন কেউ না জানলেও বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না বৃদ্ধ লোকটি যিনি উইগ দিয়ে বয়স ঢাকার চেষ্টা করছেন, তিনি ঠিক বাকি সবার মতো সুস্থ নন। সত্যি সত্যি তিনি মেরে ফেলতেন কিনা তা জানার সুযোগ নেই যেহেতু ব্যাপারটা তিনি শেষ পর্যন্ত ঘটাননি। বরং প্রশ্ন তুলেছেন, এই দূষিত পৃথিবীতে নিষ্পাপ শিশুদের বড় করা নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, এই শহরের ইট-পাথরে শৈশব নেই। কৈশোরের দুরন্তপনার মাঠ কোথায়? গাছের ডাল থেকে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার পুকুর তো কষ্ট কল্পনা। তাহলে কেন, এই দশ বছরের ছেলেটি একজন বিষণ্ন মানুষ হওয়ার জন্য বেড়ে উঠবে পৃথিবীতে?
নিঃসন্দেহে অনেক প্রয়োজনীয় কয়েকটি প্রশ্ন উথাপন করেছিলেন আজমত। লাভের ভেতর লাভ হয়েছিল, ছেলেটির বাবা-মা থানা পুলিশ করেছিল। খুশি হয়েছিলেন তিনি। তারপর সেই আনন্দ বেশিদিন থাকেনি, ফেসবুকে কোনো আলোড়ন তোলেনি দেখে। বরং তাকে মানসিক বিকারগ্রস্ত ভেবে দ্রুতই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আজমতের পরিবারের অন্যান্য লোকজন পর্যন্ত এতো বড় একটি ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামায়নি।
জোহরের আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। মুসল্লিরা একে একে তাকে পার হয়। তিনি চোখ খুলে মাটির দিকে তাকান। দেখতে পান, একটি সিগারেট ঠিক মাঝ বরাবর ছিঁড়ে পায়ের কাছে পড়ে আছে। তামাক আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে। খণ্ডিত সিগারেটের সঙ্গে দৃশ্যটি মানানসই। এতো সুচারুভাবে সিগারেটটি টুকরো হলো কী করে?
স্ট্যাচু অবস্থা থেকে সরে এসে মোবাইল বের করেন আজমত। তৎক্ষণাৎ ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেন। ক্যাপশনে লেখেন- আমাদের জীবনটাও কি এমন, দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে থাকে কারও অনুগ্রহের অপেক্ষায়?
পাঁচ মিনিট পার হয়, দশ মিনিট পার হয়, অথচ আজমতের পোস্টে একটি লাইকও আসে না। দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে তার। মিয়ম্রাণ নিঃশ্বাস, দীর্ঘশ্বাসে যেনো আরেকটু ক্লান্ত হয়। করণীয় কিছু খুঁজে না পেয়ে তিনি খণ্ডিত সিগারেটটি তুলে নিয়ে, দূরে ছুড়ে মারেন ঝোপ লক্ষ্য করে।
দুই.
সার্টিফিকেটের নাম বদলে ফেলেছেন। পরেছেন নতুন মুখোশ। বহুবার ব্যবহার করা জীর্ণ পোশাকের মতো নামটিও যেনো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন প্রাগৈতিহাসিক কোনো এক গোপন গহ্বরে। যদিও কপালে পুরোনো নামটি খোদাই করে নিলেও কেউ টের পেত না যে তার নাম আসলেই বদলে গেছে। টের পাবেই বা কীভাবে? সার্টিফিকেট, অফিস, ব্যাংক বাড়ি সব জায়গায় থাকা নিজের নাম মোহাম্মদ আজমল থেকে যে আহমাদ আজমত হাসান হয়েছে তা তো নিজ বাড়ির লোকজনই ঠিকঠাকভাবে খেয়াল করেনি।
ফেসবুকেও শুরুতে আসল নামেই ছিলেন। টুকটাক গল্প লেখা দিয়ে শুরু। একে একে সাহিত্য থেকে শুরু করে সমাজের সব পেশার মানুষের ফেসবুক বন্ধু হতে থাকলেন তিনি। দেখতে পেলেন, ক্রমান্বয়ে বন্ধুর সংখ্যা বাড়লেও লাইক-শেয়ারের অবস্থা তথৈবচ। তাই তিনি একদিন আচমকাই নিজের নাম পরিবর্তন করে বসলেন। আহমেদ আজমত হাসান। নামটি বেশ ভারিক্কি। নামের শেষে ‘মল’ থাকলে কেমন দেখায়, এই ভেবে মলের জায়গায় ‘মত’ লাগিয়ে নিয়েছেন। এতে করে, বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ফেসবুকে মত কিংবা প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকারও সৃষ্টি হয় ভেবে তিনি, নামটি চূড়ান্ত করে ফেলেন। চাকরি ছাড়ার পর থেকে আজমতের মিশন একটাই। তাকে ফেসবুক সেলিব্রেটি হতে হবে। সুতরাং, এই ধরনের নানাবিধ বাধা এলেও তিনি পিছপা হন না।
দুপুরের রোদ মিইয়ে এলে, গাছের ছায়া খানিকটা দীর্ঘ হলে, মসজিদের ভিড় কমে গেলে, দ্বিখণ্ডিত সিগারেটটি ছুঁড়ে মারার পর কিছু সময় পার হলে অবশেষে সদ্য পোস্ট করা ছবিটিতে একজন কমেন্ট করে- ভালো বলেছেন তো। আমার জীবনটাও এমন দ্বিখণ্ডিত। উৎসাহ নিয়ে আজমত আইডিটি খোলেন। তামিল নায়িকার ছবি দেওয়া। নাম দেওয়া, অ্যাঞ্জেল হিমি। মেয়েটির স্ট্যাটাসগুলো দেখতে থাকেন। প্রায় প্রতিটি স্ট্যাটাসেই হাজারখানেক লাইক, পাঁচ শতাধিক কমেন্ট। প্রায় তার সঙ্গে একই সময়ে পনের মিনিট আগের দেওয়া স্ট্যাটাসটি এমন: ‘আজ আকাশের মন ভালো নেই’। সেখানে ইতোমধ্যে কমেন্ট এসেছে প্রচুর। যেমন- আমার নামও তো আকাশ, তুমি জানলে কী করে যে আমার মন ভালো নেই। আরেকজন লিখেছে, এতো সুন্দর কবিতা দীর্ঘদিন পর পড়লাম। তোমাকে, সালাম কবি।
ফেসবুক ব্যবহারে চটপটে না হলেও, আজমত বুঝতে পারেন এতোক্ষণ পর আসলে একটি ফেক অ্যাকাউন্ট কমেন্ট করেছে তাকে। ব্লক করে বের হয়ে আসেন। ব্যাপারটি তিনি আগেও খেয়াল করেছেন যে মেয়েদের ছবি দেওয়া ফেক অ্যাকাউন্টে প্রচুর লাইক-কমেন্ট থাকে। নিজের মনকে প্ররোচিত করতে চেয়েছেন ফেক অ্যাকাউন্ট খুলতে। কিন্তু অমন সেলিব্রেটি তো তিনি হতে চান না, তিনি চান তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা হোক। হাজার হোক তার অভিজ্ঞতা কম নয়। এই যেমন ক্রিকেট নিয়ে তুমুল হই চই হয়, ক্রিকেট যে জাতীয়তাবাদী ঘৃণা প্রকাশের একটি অন্যতম মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রায় সাতশো শব্দের একটি লেখা দিয়ছিলেন। সর্ব-সাকুল্যে পনেরটি লাইক পড়েছিল, কেউ কমেন্ট করেনি। কিংবা সাব্বির রহমান যে তিন নম্বরে খেলার ব্যাটসম্যান নয়, তাও তিনি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, কেন সাব্বিরের চাইতে মমিনুল হক তিন নম্বরে ভালো ব্যাটিং করবে। তার পোস্টে রেসপন্স না থাকলেও এক ফেসবুক সেলিব্রেটির সাব্বিরকে গালি দেওয়া পোস্টে দুই হাজার লাইক দেখে আজমতের ভিমরি খাওয়ার দশা হয়েছিল। ঘৃণার বাক্য যে জনপ্রিয়তা তৈরি করে তা অবশ্য ভালোই জানতেন তিনি। তিনিও গালি-গালাজ দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছেন, তাতেও কারও নজরে আসতে পারেন ৎনি। মাঝেমধ্যে তিনি ভাবেন, আদৌ কি তাকে দেখছে ফ্রেন্ডলিস্টের পাঁচ হাজার মানুষ? এতোটা অবহেলা তো প্রাপ্য নয়। দুর্দমনীয় প্রতাপ নিয়ে চাকরি করেছেন, সচিবালয় কাঁপত তাকে দেখে, ঘুষ তো দূরে থাক, কোনোদিন একটা উপহার পর্যন্ত নেননি। দিনের পর দিন বিসিএস দিয়ে গেছেন, তারপর এই ট্রেনিং সেই ট্রেনিং করতে করতে দেখেছেন বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে। এরপর থাকতে পারতেন ছোটভাইয়ের সংসারে, কিন্তু একাই থাকে। এমন একজন সৎ, আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ কী করে এতোটা আড়ালে চলে যেতে পারে যে সামান্য ফেসবুকের চ্যাংড়া ছেলেপেলেও তার চেয়ে বেশি মনোযোগ পাবে?
তিন.
ফেসবুক থেকে হতাশা নিয়ে বের হয়েই দেখতে পান আবার তার পায়ের কাছে চলে এসেছে সিগারেটের দ্বিখণ্ডিত টুকরো। খানিক আগেই দুটো টুকরা ছুড়ে মেরেছিলেন। অথচ লাইক-কমেন্ট আসতে না চাইলেও, জড় মূল্যহীন খণ্ডিত অংশ দুটো ঠিক ঘুরে ফিরে যেনো আজমতের দুরবস্থা দেখার জন্য চলে এসেছে।
সঙ্গত কারণেই আজমত ভাবতে পারেন, এ দুটো অবশ্যই আগের টুকরো নয় বরং নতুন করে কেউ এভাবে ভেঙে রেখে গেছে। টং দোকানের ছেলের কাছে জানতে চান তিনি, এই কাণ্ড কে করছে বারবার?
: কোন কাণ্ড?
: এই যে, বারবার সিগারেট ফেলে যাচ্ছে এভাবে?
: এতো কাস্টোমারের মাঝে কে করছে, দেখার খেয়াল থাকে?
: তারপরেও, দাম দিয়ে কিনে এভাবে ফেলে যাবে? অর্থের অপচয় যারা করে, তারা মানুষ? রাস্তায় কতোজন না খেয়ে আছে।
টং দোকানের ছেলেটি অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, গত এক ঘণ্টায় এখানে আপনি ছাড়া তো আর কেউ আসে নাই।
বিহ্বল বোধ করেন আজমত। খেয়াল করেন, তিনি ছেলেটির সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা মূলত ফেসবুকীয় ভাষা। বিশেষ করে, খেলোয়াড় ও টিভি তারকাদের স্ট্যাটাসে-ছবিতে এ ধরনের কমেন্ট দেখা যায়- আপনারা কীভাবে পারলেন, এতো টাকা অপচয় করে ফাইভ-স্টার হোটেলে গিয়ে ফূর্তি করতে, কতো মানুষ না খেয়ে থাকে জানেন? সুতরাং, ছেলেটিকে বলা কথাটি যে সম্পূর্ণ অপাত্রে বলা হয়েছে, তা বুঝতে পেরে লজ্জিত বোধ করেন তিনি।
ভাবনায় ছেদ ঘটে তার অস্থির আঙুল পুনরায় মোবাইলে সচল হলে। দেখতে পান, খানিক আগে পোস্ট করা ছবিটি নেই। তবে কি, ফেক অ্যাকাউন্ট ব্লক করতে গিয়ে স্ট্যাটাস ডিলেট করে দিয়েছেন? এমন ভুল তো হওয়ার কথা নয়। গ্যালারি থেকে আপলোড করতে গিয়ে চমকে যান। কোথাও খুঁজে পান না ছবিটি। ফেসবুক থেকে কোনোভাবে মুছে গেলেও গ্যালারি থেকে কীভাবে গায়েব হয়ে যাবে? এ তো ছবি, ডুমুর ফুল নয়- আপনমনে বিড়বিড় করে বলেন।
আবার পড়ে থাকা সিগারেটের ছবিটি তুলে টুকরো দুটো আগের জায়গাতেই ছুড়ে মারেন। ফের তিনি তাকান, পায়ের দিকে। টুকরো দুটো দেখতে পান না। সুতরাং নিশ্চিত হয়ে একই ক্যাপশন দিয়ে পুনরায় ছবিটি পোস্ট করে ফেসবুক স্ক্রল করতে থাকেন।
কবিদের ভেতর আবার ঝগড়া লেগেছে। কোনো এক পত্রিকার সংকলন বের হয়েছে। যারা বাদ পড়েছে তারা হুলস্থুল সব কাণ্ড করছে ফেসবুকে। যারা সংকলনে আছে, তারাও খানিকটা বিব্রত। কবিদের ঝামেলার সুযোগ নিয়ে মাঝে একবার আলোচনায় আসার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ছন্দ নিয়ে ঝগড়া লেগেছিল তরুণ ও সিনিয়র কবিদের মাঝে। বেশ তাচ্ছিল্য নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন তিনিও। কয়েকজন তরুণ কবির পোস্টে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন, কিন্তু কেউ ফিরেও তাকায়নি। গল্পকার-কথাসাহিত্যিকদেরও খোঁচানোর চেষ্টা কম করেননি।
বাংলা কথা-সাহিত্য কোথায় যাচ্ছে, এই শিরোনামে লিখেছিলেন- আজকাল ছেলেপেলে কেউ গল্প লিখতে পারে? সব তো বানোয়াট, বাক্যের খেলা দেখাতে গিয়ে মূল গল্পের খোঁজ নেই, কেউ কেউ তো আবার হুমায়ূনের অন্ধ অনুকরণ করে বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে, এক লাইন শুদ্ধ বাক্য লিখতে পারে না, অথচ বইয়ের মুদ্রণ হচ্ছে একের পর এক, নিজেরাই নিজেদের বই কিনিয়ে বেস্ট-সেলার হচ্ছে। সর্বোচ্চ ত্রিশটি লাইক পড়েছিল সেই স্ট্যাটাসে। অথচ একই কথা যদি অন্য কেউ বলত, তবে ঠিক সয়লাব হয়ে যেত হোম ফিড।
নোটিফিকেশনের শব্দ পান। সেই ফেক অ্যাকাউন্ট ফের কমেন্ট করেছে সিগারেটের ছবিটিতে। এবার একটু ভিন্নভাবে। লেখা- আপনি, আমার মনের কথা কীভাবে জানলেন? আসলেই তো দ্বিখণ্ডিত জীবন আমাদের। কোনটা যে আসল, নিজেরাই টের পাই না। আপনি কী পান?
এবার আর অ্যাঞ্জেল হিমি অর্থাৎ ফেক অ্যাকাউন্টটি ব্লক দেন না আজমত। বরং চিন্তায় ডুবে যান। তিনি নিজেও আসলে খণ্ডিত জীবন-যাপন করছেন। এক অংশ ফেসবুকে, আরেক অংশ তার ছোট্ট ঘরে। এ কথা সত্য যে ফেসবুকের ভাগ প্রায় তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। বাকি অংশের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াও দায় এখন। পারিবারিক জীবনে যোগাযোগ বলতে, তার ভাইঝি আর ভাগ্নের সঙ্গে ফেসবুক চ্যাট। তার নিয়মিত দুজন লাইকার। এজন্য বেশ পছন্দ করেন তাদের। এই জায়গাতেও যে ফেসবুক প্রাধান্য বিস্তার করছে তা বুঝতে পেরে শরীর ছেড়ে ঘাম আসে আজমতের।
অবশ্য ফেসবুক ব্যবহার করা ছাড়া তিনি করবেনটা কী? আবার চাইলে কোনো প্রাইভেট ফার্মে জয়েন করতে পারেন- কিন্তু সারাজীবন তো কাজে কাজে গেলো। আর কতো? বিয়ে থা করেননি, প্রাক্তন প্রেমিকাদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত হয়ে গেছে। একা বাসা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই যে যার জীবনে ব্যস্ত, তিনি চাইলেও তো চক্র থেকে বের হতে পারবেন না।
কমেন্টে উত্তর দিতে গিয়ে দেখেন, পোস্টটি আবার মুছে গেছে জাদুবলে। পায়ের কাছে ঠিক হাজির হয়েছে সিগারেটের দুই টুকরো।
চার.
বারবার কেন ফিরে আসছে সিগারেটের টুকরো দুটো? তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আবারও ছবি তুলে পোস্ট করবেন। এবার অবশ্য ঝোপের দিকে ছুড়ে দেন না টুকরো দু’টো।
অপেক্ষা করতে থাকেন। ঠিক পনের মিনিট পর অ্যাঞ্জেল হিমির কমেন্ট আসে। আগের দুবারের চাইতে আলাদা। এবার লিখেছে- মনে হচ্ছে এই ছবিটায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। আমাকে কেউ মাঝ বরাবর কেটে ফেলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমান করে কাটতে পারেনি। একটা অংশ এতো বেশি কেটে ফেলেছে যে, আরেক অংশের হারিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ঠিক এই ব্যাপারটি ভাবছিলেন আজমত। এবার আগে-পিছে না ভেবে কমেন্টের উত্তর দিতে যান আজমত। কিন্তু বিধিবাম। এবার যেনো সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্য থেকে হারিয়ে গেছে পোস্টটি।
এবার যেহেতু ছুড়ে ফেলেননি, তাই টুকরো দুটো পায়ের কাছে থাকাতে আর অবাক হন না আজমত। ভেবেছিলেন, দুটোর জায়গায় চারটি হয়ে যায় কিনা। না, তা হয় নি। অবশ্য হলেও বিস্মিত হতেন না।
সুতরাং, ছবি পোস্ট ও কমেন্ট দেখার খেলা চলতে থাকে। একেকবার একেক রকম উত্তরে নিজেকে আবিষ্কার করতে থাকেন আজমত। সন্ধ্যা নেমে এলেও আবিষ্কারের নেশায় তিনি বাসায় ফিরতে পারেন না। দুপুরে পেটে কিছু পড়েনি। সে বিষয়েও খেয়াল নেই তার।
অ্যাঞ্জেল হিমি যেমন বলেছে- ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। খেয়াল করে দেখেছেন, তামাক কেমন ছড়িয়ে গেছে। চাইলেও আর জোড়া লাগতে পারবেন না। আমাদের স্বপ্নগুলোও কি অমন না? ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, অথচ একসঙ্গে মেলাতে পারছি না।
আজমত যেহেতু উত্তর দিতে পারছেন না, সেহেতু নিজেকেই যেনো বলেন- স্বপ্ন মেলানো খুব একটা জরুরি বিষয় নয়। জরুরি হচ্ছে স্বপ্নটা বুঝতে পারা। জীবনটা বুঝতে পারা। আদৌ আমার জীবনে কিংবা আমাদের জীবনে সেই স্বপ্ন দেখার জায়গা আছে কিনা।
এখন আর ফেসবুক সেলিব্রেটি হওয়া ছাড়া আজমতের জীবনে কোনো স্বপ্ন অবশিষ্ট নেই। এই সেলিব্রেটি হতে চাওয়াটা তার জীবনের সঙ্গে বিশাল একটি বৈসাদৃশ্য তৈরি করেছে। তাকে ক্লান্ত করছে স্বপ্ন পূরণের অহেতুক ভার।
এদিকে রাত নেমে আসে শিকারীর মতো চুপচাপ, ক্ষীপ্র গতিতে। অথচ সামান্য সিগারেটের খণ্ডিত অংশ আজমতের জীবনটাকে যেনো টং দোকানের সীমানায় আটকে ফেলে।
আজমত হয়তো বাসায় ফিরতে চান আবার চান না। বাসায় ফিরতে চাইলে তাকে এখান থেকে উঠতে হবে। উঠতে চাইলেও যেনো পারছেন না। টুকরো দু’টো জায়গামতো আছে। অ্যাঞ্জেল মেসেজ ব্যাক না দিলেও কমেন্ট ঠিক ব্যাক দিয়ে যাচ্ছে এবং নিয়ম করে পোস্টটি ডিলেট হয়ে যাচ্ছে। রাত যেহেতু বাড়ছে, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ছবি তুলতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে যেনো ছবিটি ঝাপসা হয়ে আসে। আর আজমতের দৃষ্টি থেকে হয়তো তার ঘরের সীমানা দূর থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।
পাঁচ.
আজমতের লাশ ভোরবেলা দোকানের সামনে থেকে খুঁজে পায় টহলরত পুলিশ। অদ্ভুতভাবে মরদেহটি দু ভাগ হয়ে পড়েছিল। যেনো কেউ টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে মাঝ বরাবর। দৃশ্যটি এতোটাই বীভৎস যে আশেপাশে থাকা কুকুরের দলও পালিয়েছে ভয় পেয়ে। দুপুরনাগাদ একটি অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক পুরো বিষয়টি নিয়ে নিউজ করলে খবরটি ভাইরাল হতে শুরু করে।
ফেসবুকে বেশ আলোড়ন ওঠে এবার। কীভাবে একজন বৃদ্ধ মানুষকে হত্যা করা হলো, এই নিয়ে পোস্টের পর পোস্ট পড়তে থাকে। কথা-সাহিত্য নিয়ে তার পুরোনো পোস্টটি ভাইরাল হয়। দশ বছরের শিশুকে হত্যা করতে চাইবার ভিডিও শেয়ার করে, কেউ কেউ লেখেন- যা হয়েছে বেশ হয়েছে। এ তো মানুষ নয়, পশুর কাজ-কারবার। কোনো যুক্তি দিয়ে কি একজন শিশুকে হত্যা করা যায়? নিমিষে পুরো ফেসবুক জগত দু ভাগ হয়ে যায়। কেউ আজমতের পক্ষে নেয়। কেউ বিপক্ষে তীব্র আক্রমণ শাণিত করে।
আজমতের বাসার চিত্রও ভিন্ন কিছু নয়। আত্মীয়-স্বজনেরা তার ছোটভাইকে দোষারোপ করতে থাকে কেন রিটায়ার্ড মানুষটার দিকে খেয়াল রাখেনি সে। এদিকে বিপক্ষের আক্রমণ পরিবারের গায়ে এসেও লাগছে দেখে তারা বিব্রত। সুতরাং, বোবা দর্শকের মতো চুপচাপ যেনো তারা সিনেমা দেখতে থাকে।
এভাবেই, আমাদের চির অচেনা আজমত সাহেব আকস্মিক ফেসবুক সেলিব্রেটি হয়ে উঠলে আমি কিংবা যে কোনো পথচারী সাত নম্বর রোডের টং দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একবার হলেও গভীর আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকাই। যদিও কোথাও খণ্ডিত কিছু চোখে পড়ে না আমাদের।
তবে গুরুত্বপূর্ণ দুটো ব্যাপার নিয়ে বিবাদমান কোনো পক্ষকেই, এমনকি পরিবারের কাউকে কথা বলতে দেখা যায় না। পুলিশ বলেছে, তাকে কোনো জোর-জবরদস্তি করা হয়নি, স্রেফ তিনি আলাদা হয়ে গেছেন। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে পাওয়া যায়নি আঘাতের চিহ্ন। এমনকি মরদেহের পাশে ছিটকে থাকা মোবাইলে যে অ্যাঞ্জেল হিমি নামে একজনের অ্যাকাউন্ট খোলা ছিলো, সেটি নিয়েও নেই কোনো উচ্চবাচ্য।
সেকেন্ডহ্যান্ড | মাহমুদ নোমান
পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন | মাসউদ আহমাদ
গিলরয় | ফারাহ্ সাঈদ
ঘর | নুসরাত নীলা
প্রেম-অপ্রেমের কাব্য | নাহিদা নাহিদ
জীবনের ছুটি নেই । জব্বার আল নাঈম
বোবা সুখ | নাদিরা মুসতারী
খুচরো আলাপ | কিঙ্কর আহ্সান
যেভাবে এহসানের ট্রেন বিষয়ক গল্পে ঢুকে পড়ি | এনামুল রেজা
যেভাবে অনিকেতের মৃত্যু হয়েছিল | আবু উবায়দাহ তামিম
আদিম | আবদুল্লাহ আল ইমরান
টান । আকাশ মামুন
এই সময়ের এক কুড়ি গল্প পড়ুন বাংলানিউজে
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১৭
এসএনএস